×

মুক্তচিন্তা

স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেবে না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:০৯ এএম

শ্রমজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ার কথা ছিল অনেক গুণ বেশি। কিন্তু তা তো বাড়েইনি, বরং কর্মীবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমেই কমছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে নারী কর্মীর অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মেয়েরা উৎপাদনের কাজ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। ঘরের কাজের অতিরিক্ত বোঝা মেয়েদের আয়-রোজগারের কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। শহরে এবং গ্রামে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়েদের বিনা মাইনে গৃহস্থালির কাজে পরিশ্রম। এর মধ্যে একটি জায়গাই শুধু সুখের খবর দেয়, আর তা হলো পোশাকশিল্পের নারী কর্মী। পোশাকশিল্পকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে রাখছে বিশেষ করে নারী কর্মীবাহিনী। একটি ভালো সংখ্যায় এখানে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের দল। সংসারের ঘানিটানা দরিদ্র পুরুষগুলো হয়তো এতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কেননা নারীর এ উপার্জনই তার সংসারকে আর্থিকভাবে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারীরা অনেক বেশি শ্রম দিলেও তাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি আমাদের রাষ্ট্র অথবা সমাজ দেয় না। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গৃহস্থালির কাজে প্রতিদিন একজন নারী গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পরিশ্রম করে, যেখানে একজন পুরুষ পরিশ্রম করে গড়ে মাত্র আধা ঘণ্টা। মেয়েদের অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণের নিম্নগতির আর একটি কারণ হলো তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ। বাড়ির বাইরে পা রাখতে গেলে কোন সময় থেকে কোন সময় বাড়ির বাইরে কাজ করা যাবে, কত দূরে কাজে যাওয়া যাবে- এসব বিষয়ে এখনো বেশিরভাগ নারীর পরিবারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। গতিবিধির স্বাধীনতার অভাবে তাই অনেক মেয়েই বাড়ি থেকে দূরের কাজে যোগ দিতে পারে না। এছাড়া আছে কাজের জায়গায় যৌন হেনস্তা। কাজের জায়গায় যৌন অত্যাচারের ফলে বহু মেয়ে কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়। কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবও মেয়েদের রোজগারের সুযোগকে সংকুচিত করে। সিনেমার নাম ‘হোলি রাইটস’। মুসলিম মেয়েদের জীবনে তিন তালাকের প্রভাব নিয়ে সিনেমাটি তৈরি করেছেন ভারতের সদ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ফারাহ্ খাতুন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালে ‘তিন তালাক’ অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৯-এ তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ইসলাম শুধু পুরুষের জন্মগত বা লিঙ্গগত অর্জন নয়, এটা তথ্যচিত্রে সাহস করে জানিয়েছেন ফারাহ্। খাঁচায় বন্দি টিয়া পাখি ঝুলছে মুক্ত আকাশের নিচে- এমন দৃশ্য আমাদের সমাজের মেয়েদের ভাগ্যের প্রতীক। তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, খাঁচাটি তৈরি করেছে মেয়েরা নিজেদের মনে। সিনেমার পরিচালক খুব জোর দিয়ে বলেছেন, ‘পুরুষদের বয়ান তো অনেক শুনলাম। এবার অন্তত নিজেদের কথা নিজেদের বয়ানে বলতে চেষ্টা করি।’ মেয়েদের এ লড়াই ঠিক আজ শুরু হয়নি। আজ থেকে বহু যুগ আগে অধিকার অর্জনের লড়াই শুরু হয়েছিল মেয়েদের। বৈষম্য আছে বলে আজো আদায়ের প্রশ্ন উঠছে। এ আলো সরল রৈখিকভাবে সোজাসুজি এসে পৌঁছায়নি, বেঁকে-চুরে, দুমড়ে-মুচড়ে এসেছে। মেয়েদের জন্য আলোকিত বৃত্ত এখনো কোথাও কোথাও গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। আজো হত্যার মতো, ধর্ষণের মতো, নিগ্রহের মতো ভয়ংকর সব কালো এসে ঘুরিয়ে দিচ্ছে আলোর গতিপথ। ‘শাট আপ’ বলে তার চারপাশে একটি শক্ত লোহার গেট টেনে দিয়ে পুরুষ তার শক্ত সামর্থ্য উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। বাংলাদেশের বেগম রোকেয়া কিংবা তারও আগে ভারতবর্ষের কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় তো বিপরীত স্রোতে টিকে থাকা কিছু ব্যতিক্রম মাত্র। ১৮৮৬-এর ১১ মার্চ কাদম্বিনী ১৪ বছর বয়সে মা হওয়া সত্ত্বেও ভারতবর্ষের প্রথম নারী ডাক্তারি পাস করে বেরিয়ে এসেছিলেন। এ মানুষগুলোর কাতারে একসময় চন্দ্রমুখী, আনন্দীবাই, রুকমাবাই, তারাবাই, শিন্ডেরা শামিল হলেও তারা প্রত্যেকেই ছিলেন ব্যতিক্রমী চরিত্র। তারা শুধু লড়াই-ই করে গিয়েছেন, সাধারণ নারীদের জায়গাটি প্রতিযোগিতামূলক করে যেতে পারেননি। তারপরও ব্যতিক্রম মাঝে মাঝে এসে ধাক্কা দিচ্ছে এ অসাম্যের সমাজে। মারওয়া এলসলেহদার- পুরুষশাসিত মিসরের প্রথম মহিলা ক্যাপ্টেন জাহাজ নিয়ে ভেসে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ছোট থেকেই সমুদ্র ভালো লাগত মারওয়ার। ভালোবাসতেন সাঁতার কাটতে। সেই ভালো লাগা থেকেই স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর তিনি চেয়েছিলেন সমুদ্র নিয়ে পড়াশোনা করতে। ২০১৩ সালে আরব একাডেমি ফর সায়েন্স, টেকনোলজি এন্ড মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনিই ছিলেন এ বিভাগে মিসরের প্রথম নারী স্নাতক। তারপর কারডিফ মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তিনিই মিসরের প্রথম নারী জাহাজ ক্যাপ্টেন হয়ে উঠেছেন। তিনি যখন এ বিভাগে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন শুধু ছেলেদেরই ওই বিভাগে ভর্তি নেয়া হতো। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাই তার আবেদন মঞ্জুর করেনি। পরে তিনি আদালতের সাহায্য নিয়ে ভর্তি হন। ক্লাসে ১ হাজার ২০০ ছাত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী। মারওয়া হার মানেননি। ২০১৫ সালে তিনি মিসরের প্রথম নারী ক্যাপ্টেন হন।পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী শক্তি মোহন। স্নাতক স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন তিনি। কিন্তু স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি আর পড়াশোনা নিয়ে এগোলেন না। বরং পেশা হিসেবে বেছে নিলেন তার নেশা নৃত্যকেই। হিন্দি ছবির কিছু সুপারহিট গানের নৃত্য পরিচালক তিনি। আছে একাধিক গানের অ্যালবাম। বসেছেন রিয়েলিটি শোয়ে বিচারকের আসনেও। নাচ ছিল তার ভালোবাসা, তার নেশা। কিন্তু ছোটবেলায় এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে। নাচ তো দূরের কথা, অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পর্যন্ত পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। সেখান থেকেই একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানো তার। আত্মবিশ্বাসে ভর করে চিকিৎসকদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি। তার নাচের কঠিন স্টেপ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, একদিন তার হাঁটাচলা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। শক্তির জন্ম ১৯৮৫ সালে দিল্লিতে। তার ছোটবেলা কেটেছে মুম্বাইতে। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু স্নাতক হওয়ার পরই ২০০৯ সালে তার নাচের শিক্ষক তাকে একটি রিয়েলিটি শোয়ে অংশগ্রহণ করান। তাতে জয়ী হন শক্তি। তারপরই টেরেন্স নেউইস ডান্স ফাউন্ডেশন স্কলারশিপ ট্রাস্ট থেকে স্কলারশিপ নিয়ে নাচে ডিপ্লোমা করেন তিনি। এরপর থেকে নাচকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার সিঁড়ি চড়তে শুরু করেন শক্তি। শক্তির কাছে এ সিঁড়ি ছিল খুব মসৃণ। একের পর এক দারুণ পারফরম্যান্স তাকে দ্রুত ক্যারিয়ারের শীর্ষে পৌঁছে দেয়। মাত্র চার বছর বয়সে শক্তি একদিন বোনকে নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগতিতে ছুটে আসা একটি মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার পায়ের ওপর ওঠে যায়। সাত মাস বিছানা থেকে উঠতে পারেননি তিনি। অনেক চিকিৎসার পর শক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। শুধু হাঁটাচলাই নয়, নির্দ্বিধায় এবং মুক্তভাবে নাচতেও শুরু করেন কয়েক মাসের মধ্যে। সেই মেয়েই আজকের বলিউড জগতে সাড়া জাগানো নৃত্য পরিচালক শক্তি মোহন। সেদিনের কাদম্বিনী, চন্দ্রমুখী, আনিন্দবাই, রুকমাবাই কিংবা তারাবাই এবং আজকের মারওয়া, শক্তি মোহন, পূজা দেবী কিংবা নোরা- যারা নিজেদের পথে নিজেরাই চালিকাশক্তি- তাদেরকে কি সমাজের নারী জাগরণের উদাহরণ বলব, না ব্যতিক্রম বলব? নারী বিদ্বেষ এবং পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ধর্ষণের জন্য আজো ধর্ষিতাকে দোষী সাব্যস্ত করে কিংবা ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ধর্ষিতাকে সব সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়ার পরামর্শ প্রদান করে। এমনকি বিচারকের আসনে বসে ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতা মেয়েটির বিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সামাজিক সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নেন বিচারকও। সমাজ কিংবা আইন বুঝতেই পারছে না, ধর্ষকের সমস্যা সমাধানের এ উপায় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির আইনি, সামাজিক এবং মানবিক অধিকার কতটুকু নস্যাৎ করছে। ব্যতিক্রম কিংবা উদাহরণ যা-ই বলি না কেন, এদের ছবি ছড়িয়ে যাক সমাজের সব মানুষের দ্বারে দ্বারে। নারীদের পাশে দাঁড়াক সচেতন পুরুষরাও। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাদের দাবি আদায়ের কর্মীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাক। একদিন এসব ব্যতিক্রম সমাজের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়াক এ আশায়। মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App