×

জাতীয়

যত ছাড় তত ঋণখেলাপি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩০ এএম

করোনার কারণে গত বছর খেলাপি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সব ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া না হলেও বড় বড় ঋণের ক্ষেত্রে গত আগস্ট পর্যন্ত ছাড় বহাল ছিল। এত ছাড়ের পরও ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরো বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তারা মনে করেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি হওয়ার পেছনে নানা কারণ তো রয়েছেই, তবে ব্যাংকগুলোর যোগসাজশই বেশি। বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিই উদ্যোক্তাকে ঋণখেলাপি হতে উৎসাহিত করছে। আর প্রকৃত উদ্যোক্তারা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন দায়দেনার ভারে। জ্বালানি সংকট, ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন তো রয়েছেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত জুন মাসে খেলাপি হয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের পর থেকে গত জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণ বিতরণের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মাস অন্তর খেলাপি ঋণের যে হিসাব তৈরি করে, তাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। এর সঙ্গে অবলোপন করা আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরো বেড়ে যাবে। এছাড়া পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন আছে বিপুল অঙ্কের ঋণ। এর বাইরে আরো লাখ কোটি টাকার মতো আছে মেয়াদোত্তীর্ণ ও স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট বা এসএমএ ঋণ, যা খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে। এর বাইরে আরো অনেক ঋণ খেলাপির পর্যায়ে আছে অথচ ব্যাংকগুলো সেগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক বেশি হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, করোনার কারণে কিস্তি পরিশোধে শৈথিল্য থাকলেও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। আর পদ্ধতিগত জটিলতা ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে প্রকৃত উদ্যোক্তারা খেলাপি হলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বহাল তবিয়তেই থাকছেন। বরং তাদের জন্য রয়েছে নানা ছাড়, নানা কৌশলে সময়ক্ষেপণ ছাড়াও নানাবিধ সুবিধা। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রশ্রয়েই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য নানা সুবিধা থাকে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। কিন্তু প্রকৃত উদ্যোক্তারা সঠিক মূল্যায়ন পান না। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, প্রভাবশালী এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ঋণ পরিশোধে বছরের পর বছর সময় পেয়েছেন। কেউ কেউ আছেন- যারা সময় নিয়েও কিস্তির টাকা ঠিক সময়ে পরিশোধ করেননি। কেউ কেউ বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যার প্রতি খুশি থাকে, তিনি সর্বোচ্চ সুবিধাই পেয়ে যান। এমনকি নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রভাবশালীদের পরোক্ষ হাত থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারির সময় অনেক খেলাপি ঋণ বেড়েছে তা কিন্তু নয়। আগে যেখানে খেলাপি ঋণের মাত্রা ডাবল ডিজিটে ছিল, এখন তা কমে সিঙ্গেল ডিজিটে চলে এসেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, এক কোয়ার্টারে রিকভার হয় না, অন্য কোয়ার্টারে তার চেয়ে অনেক বেশি রিকভার হয়েছে।

সূত্রমতে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে নানা ছাড় দিলেও মূলত কিছু মুখ্য সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে নতুন উদ্যোক্তা যেমন উৎসাহিত হচ্ছেন না, তেমনি পুরনো উদ্যোক্তাদেরও নাভিশ্বাস চরমে। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কারণে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘœ ঘটছে। তদুপরি, পণ্য পরিবহন জটিলতা, বিভিন্ন স্থানে কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে হয়রানিসহ নানাবিধ জটিলতায় রপ্তানি বাজারও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক গুরুত্ব পাচ্ছে বিশেষ গোষ্ঠীর বেলায়। ব্যাংকিং সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে পণ্যমূল্য কমছে। তদুপরি, ডলারের দামও বেড়েছে। একটি প্রকল্পের বিপরীতে যখন ঋণ দেয়া হয়, তখন ডলারের যে মূল্য থাকে পরবর্তী সময়ে তা বেড়ে যায়। এদিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিচালনা বোর্ডের যোগসাজশে নিজেদের পছন্দের কিছু গ্রাহককেই বেছে নেয়। যারা সব সময়ই সুবিধা পেয়ে থাকেন। এদের সুদহার কমানো থেকে শুরু করে ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দেয়া হয়। দেখা গেছে, বর্তমানে করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দোহাই দিয়ে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের কাঁধে ভর করে মূলত বড় সুবিধা ইচ্ছাকৃত খেলাপিরাই নিয়ে নিয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সুবিধা লুটে নিয়েছে বলেও সূত্রগুলো মনে করছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা মহামারির প্রভাবে অর্থনীতিতে এমনিতেই একটি মন্থর গতি বিরাজ করছে। এ কারণে অনেক উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছেন না। তবে অনেকেই আছেন, যাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিটি ব্যাংকে মনিটরিং করা উচিত। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভালো গ্রাহক এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি- দুজনকে আলাদা করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, আর যারা ভালো গ্রাহক কিন্তু ব্যবসা মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না- তাদের কীভাবে নিয়মিত করা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদকে বলতে হবে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে তদারকি করতে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছিল প্রণোদনার অর্থ ঋণখেলাপিদের দেয়া যাবে না। এর ব্যত্যয় হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, যাদের ব্যবসা করোনার সময় আক্রান্ত হয়েছে ঋণ নেয়ার পরও তারা হয়তো সেটা রিকভার করতে পারেনি। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছিল। এখন সবচেয়ে বড় জরুরি হচ্ছে এটা বের করা- করোনা চলাকালে কারা সমস্যায় পড়েছেন।

নামেই ব্যাংক কোম্পানি আইন : চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধিত খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিরা বিদেশে যেতে পারবেন না। এমনকি খেলাপি ঋণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও হতে পারবেন না বলে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়। নতুন খসড়ায় স্বেচ্ছা খেলাপিদের বাড়ি, গাড়ি, কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানো ও কোনো সংগঠনে পদ না পাওয়ার প্রস্তাব আগের মতোই বহাল রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছা খেলাপিদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমিটি ওই তালিকা চূড়ান্ত করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App