×

জাতীয়

শিক্ষার্থীদের চোখে সর্ষে ফুল : অ্যাসাইনমেন্ট-ওয়ার্কশিট নিয়ে বাড়াবাড়ি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৫৭ এএম

শিক্ষার্থীদের চোখে সর্ষে ফুল : অ্যাসাইনমেন্ট-ওয়ার্কশিট নিয়ে বাড়াবাড়ি
শিক্ষার্থীদের চোখে সর্ষে ফুল : অ্যাসাইনমেন্ট-ওয়ার্কশিট নিয়ে বাড়াবাড়ি

ফাইল ছবি

করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যাতে ঘরে থেকে পাঠ্যবই পড়ে উত্তর দিতে পারে, সেজন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ওয়ার্কশিট’ পদ্ধতি চালু করে সরকার। গত ছয় সপ্তাহ ধরে পাঠদানের নতুন এ পদ্ধতি শিশু-কিশোরদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এখন দেখাদেখি বা নকল করে অ্যাসাইনমেন্ট ও ওয়ার্কশিট লিখে জমা দেয়াই শিক্ষার্থীদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে কোনো শিখনফল অর্জিত হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখতে সরকার অনলাইন ক্লাস, টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু করে। উচ্চশিক্ষায় অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষা পরিচিত হলেও নিম্ন শিক্ষায় এটি একেবারেই অপরিচিতি। এ রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা বিলি করে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় ‘ওয়ার্কশিট’ বিলি করে।

অ্যাসাইনমেন্ট এবং ওয়ার্কশিট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অ্যাসাইনমেন্টে পাঠ্যবই থেকে প্রশ্ন আসার কথা থাকলেও তা হয়েছে পাঠ্যবইবহির্ভূত। ওয়ার্কশিটে বেশি বেশি প্রশ্ন দেয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়ে নিজে নিজে প্রশ্নের উত্তর করতে পারেনি। এরপরই তারা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে দেখাদেখি করে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর লিখতে শুরু করে। ক্ষেত্রবিশেষে নকল করেও অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর লিখছে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ওয়ার্কশিটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের প্রশ্নের উত্তর লিখে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে কর্মরত রসায়নবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যুৎ চন্দ্র রায় ভোরের কাগজকে বলেন, অ্যাসাইনমেন্ট যেদিন প্রকাশ প্রকাশ হওয়ার কথা সেদিন হয় না।

দেখা যায়, যেদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে অনেক সময় তার মাত্র একদিন আগে অ্যাসাইনমেন্ট পায় শিক্ষার্থীরা। এতে উত্তর লিখতে শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত সময়ই পায় না। একসঙ্গে একদিন সময়ের মধ্যে দুটি বা তিনটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে হয়। সব মিলিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ছেলেমেয়েরা ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছে। কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এমন উদ্ভট জ্ঞান বের হচ্ছে- প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, অ্যাসাইনমেন্টে কিছু প্রশ্ন জুড়ে দেয়া হয়েছে-  স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থীরা উত্তর দিতে পারবে? মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা পারবেই না। এতে শিক্ষার্থীরা নকলের দিকে ঝুঁকছে।

তবে কোনো শিক্ষার্থীই নকল করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে না বলে দাবি করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্তের অনেকে সমালোচনা করেছে। তবে এক্ষেত্রে আমরা সফল। কোনো শিক্ষার্থীই নকল করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, অ্যাসাইনমেন্টে পাঠ্যবইবহির্ভূত কোনো প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে না। স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের মাধ্যমে কর্মশালা করে পাঠ্যবইয়ে যা আছে, তার মধ্য থেকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। কাজেই পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন সম্পর্কিত যে অভিযোগ এসেছে, তা ঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি। তার মতে, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। নানাজন নানা কথা বললেও এ পদ্ধতির শিক্ষা বিশ্বস্বীকৃত। এ পদ্ধতির শিক্ষা কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলতে পারে না।

অ্যাসাইনমেন্ট ঘেঁটে দেখা গেছে, দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্টে পাঠ্যবইয়ের ১৮ থেকে ২৭ নম্বর পৃষ্ঠা অনুসরণের কথা বলা ছিল। প্রশ্নে কাগজের মান ছিল গ্রাম/মিটার। কিন্তু বইয়ের ১৮ পৃষ্ঠায় শুধু বলের মাত্রা দেয়া থাকলেও তা কত হবে, তা পরিষ্কার করে বলা নেই। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই গ্রাম/মিটারের মাত্রা বের করতে পারবে না। অ্যাসাইনমেন্টে উত্তর লিখতে হলে শিক্ষার্থীদের স্যার, গাইড বা ইউটিউবের পরামর্শ নিতে হবে। পরের প্রশ্নতেও কিলোগ্রামে মাপলে এই একক কী হবে, তাও বইয়ের ১৮ থেকে ২৭ পৃষ্ঠার মধ্যে নেই। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কতগুলো কাগজ কিনতে হবে, এমন প্রশ্নের অনুরূপ কোনো প্রশ্নই পাঠ্যবইতে নেই। অ্যাসাইনমেন্টে প্রশ্ন ছিল, কাগজের প্যাকেটের গায়ে যদি লেখা থাকে (১২০+.৫) গ্রাম/মিটার- প্রশ্নটিই কিন্তু পরিষ্কার নয়। পাঠ্যবইয়েও তা নেই। আবার হঠাৎ করেই বলেছে, তোমার নির্ণীত মানের কতটুকু সূ² বা নির্ভুল? আসলে এখানে ভর, আয়তন ইত্যাদি আছে। একেক শিক্ষার্থী একেক ধরনের উত্তর দিয়েছে। এটা ঠিক, পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ১৮-২৭ পৃষ্ঠার মধ্যে এমন অনুরূপ প্রশ্নের কোনো উদাহরণ নেই। বইয়ে অন্য রকমভাবে অন্য একটি অংশের সামান্য তথ্য আছে। ওই তথ্য দেখে অঙ্কটি কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। একইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্টের প্রশ্নেও গড়বড় আছে।

দশম শ্রেণির রসায়নবিজ্ঞানের প্রথম সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্ট প্রশ্ন ঘেঁটে দেখা গেছে, বইয়ের পৃষ্ঠাতে শুধু তৃতীয় অধ্যায়ের তথ্য রয়েছে। বইয়ের পৃষ্ঠার কোনো উল্লেখ নেই। এখানে শুধু উদ্দীপক দেয়া আছে। কী প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তা মূল্যায়ন থেকে বুঝে নিতে হবে। এমনভাবে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে যার মধ্যে কখনো উদ্দীপক, মূল্যায়ন ও নির্দেশনা রয়েছে। এতে উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পুরোটাই বিভ্রান্ত হয়েছে। অন্য প্রশ্নে বোর মডেল অনুসরণ করে চারটি মৌলের চিত্র অঙ্কন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু দশম শ্রেণির রসায়নের তৃতীয় অধ্যায়ে এই রকম কোনো চিত্র অঙ্কন করে দেয়া নেই। এতেও শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়েছে। এছাড়া যে চারটি মৌলের (এনএ, পি, কে, সিইউ) উপশক্তি স্তর অনুসারে ইলেকট্রন বিন্যাস করতে হবে, সেই চারটি মৌলের তথ্য পাঠ্যবইয়েই নেই। ভিনেগারের সংকেত বইয়ে না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্টে তা তুলে দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একজন শিক্ষক ভোরের কাগজকে বলেন, পাঠ্যবইয়ে না থাকায় এসব প্রশ্নের উত্তর লিখতে হলে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই গাইড বই ও ইউটিউবের সাহায্য নিতে হবে। ঢাকা শহরের কিছু ছেলেমেয়ে হয়তো উত্তরগুলো দিতে পারবে, কিন্তু পাঠ্যবইয়ে না থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের কেউই এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।

একাদশ শ্রেণির উচ্চতর গণিতের প্রথম সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্ট প্রশ্ন ঘেঁটে দেখা গেছে, উদ্দীপকে লেখা আছে- এক্স অক্ষের ধনাত্মক দিকের সঙ্গে কত ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করবে? কিন্তু এই রকম কোনো অঙ্কের উদাহরণ বইতেই নেই। পরের সপ্তাহগুলোতে এসেও উচ্চতর গণিতের অ্যাসাইনমেন্টে এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে, যা বইতে নেই। ঘড়ির কাঁটার অঙ্ক পাঠ্যবইয়ের উদাহরণে নেই। অনুশীলনীতে আছে। কিন্তু অনুশীলনীর অঙ্ক নিজে নিজে করা সম্ভব নয়।

একাধিক শিক্ষক বলেছেন, একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে কোনোভাবেই শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া সমাধান করা সম্ভব নয়। তবু যারা সমাধান করেছে বলে দাবি করেছে, তারা অবশ্যই গাইড, কোচিং ও ইউটিউবের সাহায্য নিয়ে করেছে।

প্রাথমিকের ওয়ার্কশিট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর জন্য ৫০টি প্রশ্ন সংবলিত ওয়ার্কশিট দেয়া হয়েছে এবং সমাধান করতে মাত্র ৮ দিন সময় দেয়া হয়েছে। একইভাবে চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণিতেও মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন দিয়ে ওয়ার্কশিট তৈরি করা হয়েছে। যার উত্তর দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার খামতিওর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা বীভা বড়াল ভোরের কাগজকে বলেন, ওয়ার্কশিটে লেখা উত্তরগুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বড় কেউ লিখে দিয়েছেন। কিন্তু এসব দেখেও বলার কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে দীর্ঘ ১৭ মাস বন্ধ থাকার পর আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলছে। এরপর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সপ্তাহে একদিন স্কুলে হাজির হয়ে ক্লাস করবে। সশরীরে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় প্রাথমিকে ওয়ার্কশিট কার্যক্রম চলবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, সশরীরে ক্লাসের পাশাপাশি ওয়ার্কশিট কার্যক্রমও চলবে। এই ওয়ার্কশিট কার্যক্রমও একটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা বলে জানান তিনি।

স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চলবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সোমবার রাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বলেন, ক্লাসের বিকল্প হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম ছিল। এখন যেহেতু সশরীরে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে, সেক্ষেত্রে নতুন করে আর অ্যাসাইনমেন্ট না-ও দেয়া হতে পারে। চলমান অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদেরকে জমা দিতে হবে। তবে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা চাইবেন অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষা ব্যবস্থা যেন চালু থাকে। এর অনেক সুফল রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App