×

মুক্তচিন্তা

মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং তার স্বাস্থ্যসেবা দর্শন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০৬ এএম

জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) ছিলেন করুণায়, মানবতায়, সেবায়, বলিষ্ঠতায়, দানে, ধ্যানে, ব্যক্তিত্বে এক বিরাট কর্মী পুরুষ। চিন্তায় স্থির, পরিকল্পনায় ধীর, কর্মে বীর তিনি ছিলেন সাধনা-পূর্ত জীবনের অধিকারী। একজন আদর্শবাদী স্বপ্নস্রষ্টা এবং তার ছিল সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখিতা ও কঠোর পরিশ্রমক্ষমতা। তার একটি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল- যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন তাদের মধ্যে তিনি তার অফুরন্ত উৎসাহ উদ্যম, অগাধ বিশ্বাস ও অসাধারণ কর্মশক্তির সামান্য হলেও কিছুটা সঞ্চারিত করে দিতে পারতেন। ফলে সরকারের ও সরকারের বাইরে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা পদে ও বৃত্তিতে যারা নিয়োজিত তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য ও সহযোগিতা তিনি সর্বদাই পেয়েছেন। তিনি একটি অটল আনুগত্যসম্পন্ন নিবেদিতপ্রাণ কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মীগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু দিবসকে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাল্যজীবনে ডা. ইব্রাহিম যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন তা হলো বড় মানুষ হওয়া, বড় লোক হওয়া নয়। এই লক্ষ্য অর্জনে তার সাধনার প্রেরণার উৎস ঐতিহ্যবাহী পরিবারের আদর্শ, এই আদর্শকে চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য করে তুলতে তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। সৎ, নির্ভীক, নির্লোভ, উচ্চাকাক্সক্ষী দৃঢ়চিত্ত মনোবলের জন্যই অজপাড়া গাঁয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে কলকাতা এবং ঢাকার পথ পেরিয়ে বিশ্ব পরিক্রমায় বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, দেশ-বিদেশের বৃহৎ সমাজে অত্যন্ত সুপরিচিত হয়ে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন তিনি। সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছিলেন, কিন্তু কখনো নিজের ঐতিহ্যবাহী আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ হননি। তার মহৎ কর্মের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন, যেমন- পাকিস্তান সরকারের সিতারা ই খিদমত (১৯৬৩), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৭৯), বেগম জেবুন্নিসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ পাবলিক ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট স্বর্ণপদক (১৯৮১), মাহবুব আলী খান স্বর্ণপদক (১৯৮৫), খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ স্মারক স্বর্ণপদক (১৯৮৭) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৮৯)। অলঙ্কৃত করেছেন জাতীয় পর্যায়ের অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ, যেমন- তদানীন্তন পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি (১৯৬৬-৭১ এবং ১৯৭২-৮৯), পাকিস্তান জাতীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি (১৯৬৯-৭০), বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানসের সভাপতি (১৯৭৬-৮১), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর সাইন্টিস্ট এন্ড প্রফেসনসের সভাপতি (১৯৭২-৮২) ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য (১৯৮২-৮৪), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর দ্য এজিংয়ের নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ (১৯৮৩) অনেক মর্যাদার আসনে আসীন ছিলেন তিনি। নিজের পেশা চিকিৎসা তথা স্বাস্থ্যসেবক হিসেবে তিনি মানতেন, ‘মানসিক তৃপ্তিই চিকিৎসকের জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।’ তার উপলব্ধি, ‘সমানুভূতি (ঊসঢ়ধঃযু) না থাকলে চিকিৎসার পেশা হবে প্রাণহীনভাবে অর্থ উপার্জনের একটা পথ। সে ক্ষেত্রে এই মহান পেশার মানবিক দিকটা লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, সাধারণ মানুষের চোখে তা প্রতিভাত হবে নিতান্তই কদর্যরূপে।’ তার অভিমত, ‘একজন ব্যবসায়ীর অর্থ উপার্জনের নেশা আর একজন চিকিৎসকের অর্থ উপার্জন এক হলে তা অবশ্যই সমাজের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের কথা।’ তার বিশ্বাস, ‘চিকিৎসক সেবাধর্মী পেশা আর সেবার মাধ্যমেই স্রষ্টার নৈকট্য ও রহমত পাওয়া যায়।’ তিনি এ উপলব্ধি, অভিমত ও বিশ্বাসকে আজীবন সযতেœ লালন করেছেন। তার স্বগতোক্তি- ‘আমি জানি মানুষের জীবনের পরিধি সসীম এবং কর্মের পরিধি অসীম। অবশ্যই এই কর্মটা খাঁটি হতে হবে, জনকল্যাণমূলক হতে হবে। আমি আজীবন সত্যকর্মের সাধক হওয়ার চেষ্টা করে চলছি। … জীবনের পঁচাত্তরটা বসন্ত পেরিয়ে সাধনাতেই নিমগ্ন হয়ে রয়েছি। আল্লাহর কাছে একাগ্রমনে আমি শক্তি চাই, যে শক্তি দিয়ে আমি মানুষের কল্যাণ করতে পারব, রুগ্ণ-পীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারব।’ রোগ ভালো না করে টাকা নেয়া ডা. ইব্রাহিমের কাছে লজ্জাবোধ হতো। সেজন্যই ভালো করা যায় না এমন রোগ ডায়াবেটিসের জন্য তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বিনা পয়সার চিকিৎসালয় খুলতে। চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি জনসেবা করবেন, এটাই ছিল তার মূল জীবন দর্শন। রোগীর পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তার ইব্রাহিম ছিলেন নৈপুণ্য ও সূ²তার প্রতি অচঞ্চল; এর মধ্যেই তিনি তার শিক্ষার্থী সহকর্মীদের শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিতেন রোগীর রোগ পরীক্ষণ ও নির্ণয় বিষয়টি কত নিখুঁত ও সূ² হওয়া উচিত এবং তিনি কীভাবে তা চান। তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন হাতে-কলমে শিক্ষাদাতা এবং একাধারে তার চিকিৎসা দর্শনের মর্মসাধক- ‘আমি নিজে একটা কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এবং আমার সহকর্মীদের এ কথাটা আমি সবসময় বলি যে, আমরা জনগণের খাদেম, এ মনোভাব নিয়ে সেবা করব; তাদের প্রভু এ মানসিকতা নিয়ে নয়। কারণ নিজেকে খাদেম মনে করলেই সেবাটা আন্তরিক হয়, মনের মধ্যে বিনয় আসে আর মানুষের প্রতি একটা মানবিক সহমর্মিতা জেগে ওঠে। আর এ সহমর্মিতা বা সমানুভূতি একজন রোগীর দুঃখ-কষ্ট যদি হৃদয়ঙ্গম না করি তবে তো আমার সেবাটা হবে অনেকটা দায়সারা গোছের। কিন্তু আমি যদি চিন্তা করি যে এ রোগীর জায়গায় আমি থাকলে কী হতো, তাহলে দেখা যাবে আমার চিকিৎসার ধ্যান-ধারণাই বদলে গেছে। আমি নিজে যেমন এ মনোভাবের অনুবর্তী সে রকম অন্যদেরও এটা অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে থাকি। আর একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না, তা হলো আমাদের এই জনগণ হলো স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জনগণ। এরা ১৯৪৭ সালের আগের ব্রিটিশদের গোলাম জনগণ নয়। এরা ১৯৭১ সালের আগের জনগণ নয়। যখন এদেশকে বলা হতো কালোনি। এরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের জনগণ।’ ডা. ইব্রাহিম চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে, অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সঙ্গে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মনে না করলে যেমন দুঃখী বা আর্তপীড়িতের গভীরে যাওয়া যাবে না ঠিক তেমনি তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী সব ডাক্তার, সেবাকর্মী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের তিনি সব সময়ে বলতেন ‘ইম্পেথি’ শব্দটির অন্তর্নিহিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবা দানে মনোনিবেশ করতে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সে সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে। এভাবেই কোনো সেবাদানকারী সেবা গ্রহণকারীর গভীরে প্রবেশ করতে পারবে, আর যখন সেবাদানকারী মনে করবে আমি যদি এই আর্তপীড়িত লোকটির মতো হতাম, যে আমার কাছে তার আর্তপীড়ার উপশম চাইতে আসছে এবং আর্তপীড়িতটি যদি আমার জায়গায় হতো, যার কাছ থেকে আমি পীড়িত হয়ে সেবা গ্রহণ করতে এসেছি। রোগীদের সেবা প্রদানকারীর এরূপ ধারণাই থাকা উচিত যে, তারা বিনা পয়সায় সেবা গ্রহণ করতে এসেছে এবং এর জন্য তাদের সেবা প্রদানকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার চেতনাবোধ থাকতে হবে। তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান বারডেমে সকালবেলা যখন সব ডায়াবেটিস রোগী এসে একত্রিত হতো তখন তিনি তাদের বলতেন : আপনারা যে এসেছেন এজন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আপনারা এখানে এসে আমাদের সেবা করার সুযোগ দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে ডা. ইব্রাহিম তার সেবাদানকারী সহকর্মীদের বলতেন, তারা যেন রোগীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এজন্য যে, তারা (রোগীরা) এখানে আমাদের সেবা গ্রহণ করতে এসেছে এবং তারা না এলে আমাদের কাজ থাকত না। তিনি নিজে বয়স্ক, বিশেষ করে বুড়ো মানুষদের, সে যত সাধারণই হোক না কেন, মন-প্রাণ দিয়ে সম্মান করতেন। কোনো একজন বুড়ো মানুষ তার চেম্বারে ঢুকলে তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে যেতেন। তার কথা শুনতেন, আবার প্রয়োজন হলে নিজেই হাত ধরে চেয়ারে বসাতেন। বহির্বিভাগ বা ভেতর বিভাগে পরিদর্শনরত অবস্থায় এরূপ কোনো ব্যক্তিকে ইতস্তত ঘুরতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার খবর নিতেন। তিনি শুধু পীড়িতদের পীড়ার কারণ শুনেই ক্ষান্ত হতেন না, তাদের জীবনের সব কথা-কাহিনী, রোগীর পিতা-মাতা, সমাজ-সংসার সব ব্যাপারেই খোঁজ-খবর নিতেন। এর ফলে প্রত্যেক রোগীই হয়ে উঠত তার আত্মার আত্মীয়। রোগীরা তখন আর তাকে কেবল একজন ডাক্তার বলে মনে করতেন না, মনে করতেন একজন পরম আত্মীয়। রোগী ও ডাক্তারের মধ্যকার এরূপ প্রত্যক্ষ, ঘনিষ্ঠ ও স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক সত্যি বিরল। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা বড় কঠিন সেই প্রীতি ও মমতাকে কাজে লাগানোর জন্য সংবেদনশীল হৃদয় দরকার। একটা নির্দিষ্ট সময়ে চেম্বারে বসা, রোগী দেখা, ব্যবস্থাপত্র দেয়া ও মোটা অঙ্কের কনসালটেশন ফি নেয়া- এই রুটিন পালন করাই কোনো দায়িত্বশীল চিকিৎসকের প্রকৃত কর্তব্য বলে তিনি মনে করতেন না। তিনি রোগী দেখতেন, জনগণকে রোগমুক্ত রাখার কথা ভাবতেন, জনস্বাস্থ্যের কথা ভাবতেন। তার এসব এবং এমন ভাবনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। চিকিৎসা শুধু একটা অর্থকরী ও লাভজনক পেশা নয়। রুগ্ণকে নিরোগ করা ও সুস্থ রাখা চিকিৎসকের মানসিক ও ধর্মীয় করণীয় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই কেবল কয়েকজন রোগীর চিকিৎসা করেই একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব শেষ হয় না বলে তিনি মনে করতেন। : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App