×

মুক্তচিন্তা

তালেবান দেশ পরিচালনায় সফল হবে কি?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০৬ এএম

আফগানিস্তান ৯৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর দেশ। খুবই সামান্যসংখ্যক হিন্দু, শিখ এবং খ্রিস্টান রয়েছে। এর আগের তালেবান সরকার হিন্দুদের হলুদ ব্যাজ পরে রাস্তায় বের হতে বলেছিল, যাতে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। মোল্লা ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালে বামিয়ানে বৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কাবুলের জাদুঘর থেকে অসংখ্য মূর্তি ইসলামিক রীতিবিরুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। বিগত সময়ে আফগানিস্তানে রুশদের ক্ষমতা দখলের সময় ১৫টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তালেবানরা সবগুলো বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের মুখপাত্র হিসেবে মাত্র দুটি পত্রিকা রেখে দিয়েছিল। ক্রিকেট খেলা ও মেয়েদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছিল। দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী পশতুন হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে দুটি গোষ্ঠী। একটি দুররানি পশতুন, আরেকটি গিলজারি পশতুন। এছাড়া উজবেক, তাজিক ও হাজারাসহ আরো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে তালেবানদের মধ্যে অধিকাংশই পশতুন জনগোষ্ঠীর। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতময় এক পরিস্থিতি বরাবরই ছিল আফগানিস্তানে। কিন্তু ইতিহাস বলে সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আফগানিস্তান এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আফগানিস্তান বরাবরই বিদেশি শক্তির জন্য এক ধরনের চোরাবালি। দেশটি এর আগে ১৯৮৯ পর্যন্ত ১০ বছর দখলে রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রায় ১০ বছর ধরে চলা দীর্ঘ ওই যুদ্ধকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। ওই যুদ্ধকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনেরও অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কেননা এর ঠিক দুই বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। আর এ বছর আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হয় মার্কিন সৈন্য। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করে। ২০০১ সাল থেকে প্রায় দুই দশক আমেরিকার সৈন্যরা আফগানিস্তানে অবস্থান করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান আফগানিস্তান শাসন করে। তালেবান শাসনের ব্যাপক সমালোচনা হয় বিশ্বব্যাপী। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরেও এক ধরনের গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা তৈরি হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন; কিন্তু কার্যত দেশটি এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান ঘটান। দুই দশক থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, তখন থেকেই তালেবানরা তাদের ব্যাপক শক্তিমত্তা নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। অবশেষে আফগানিস্তানে সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। আফগানিস্তান তালেবান সরকার গঠন নিয়ে মতবিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। গোষ্ঠীগত স্বার্থে নিজেদের মধ্যে নানা টানাপড়েন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে হাক্কানি গোষ্ঠী ও ইয়াকুব গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ সবচেয়ে বড় আকার নিয়েছে। জানা গেছে, তালেবান প্রধান হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা চাইছেন তিনি ইরানের মতো সরকারের ‘সুপ্রিম লিডার’ হবেন, যাতে তার উপদেশ মেনেই দেশ চালান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এতে রাজি নন অনেক নেতা। সরকার গঠন নিয়ে ঘাম ছুটছে তালেবান নেতাদের। নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা পুনরায় যখন তালেবানের হাতে যাচ্ছে, তখন আফগানিস্তানের জন্য কী অপেক্ষা করছে- এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর আগে ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখনই আমরা তাদের শাসনের রূপ দেখেছিলাম। তারা ইসলামের নামে মানবসভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নারীদের পশ্চাৎপদ করে রাখে। ওই সময় দেশটির জনগণ, বিশেষ করে আফগান নারীদের স্বাধীনতা তারা খর্ব করেছে। ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। আরব দেশের মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পাকিস্তান তালেবান সরকারকে সমর্থন দেয়। যদিও তখনো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাদের সাম্প্রদায়িক শাসনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় জঙ্গিগোষ্ঠী। তালেবানি পশ্চাৎপদ শক্তিগুলো আফগানিস্তানে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় আরো বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত হতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বর্তমানে তালেবানের আচরণে একটা বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, পূর্বের তালেবান ছিল অনেক বেশি কট্টরপন্থি ও রক্ষণশীল। আর বর্তমান তালেবান কিছুটা উদার ও আধুনিক মনোভাবাসম্পন্ন। তারা চেষ্টা করছে সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক স্থাপন করে দেশ পরিচালনার। তালেবান দাবি করছে যে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও সেবা দেয়া তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ঠিক হবে না। যদি তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে আফগানিস্তান সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের চারণভূমিতে পরিণত হবে। যা বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করবে। আমরা দেখছি, চীন, রাশিয়া, কাতার, ইরান ও পাকিস্তান তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা করছে। যদিও এসব দেশ সব পক্ষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলছে। তার মানে আফগানিস্তানে আমরা পরাশক্তিরও নতুন পালাবদল দেখছি। আফগানিস্তানে ক্ষমতা পালাবদলের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্র ভারতের জন্য তেমন সুখকর মনে হচ্ছে না। হঠাৎ করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ও তালেবানরা রাতারাতি আফগানিস্তান দখল করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে ভারতের মিত্র আশরাফ গণি সরকার পতনের ঘটনা এবং তালেবান কাশ্মিরের জনগণের পাশে থাকার ঘোষণায় ভারতের জন্য কিছুটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে। কাবুলে নতুন সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে তালেবান। তারা জানিয়েছে, এ সরকার হবে বহুদলীয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। যাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও বর্তমান প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। তালেবানের নেতৃত্বে নতুন সরকার যদি গঠিত হয়, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে, তা নিয়ে দোটানায় ভুগছে পশ্চিমা বিশ্ব। বলা হচ্ছে, তালেবান ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তানে আবার সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ কেউ বলছেন, আলকায়েদা ও আইসিস উভয়েই ইতোমধ্যে সেখানে পা ফেলার মতো জায়গা করে নিয়েছে। তবে পরিস্থিতি কোনদিকে যায়, আপাতত সেটাই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তালেবান যদি আগের উগ্রবাদী আচরণ অব্যাহত রাখে তবে সংকট ঘনীভূত এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি সংকট আমরা দেখছি, আফগানিস্তান নিয়ে পরাশক্তির খেলা। ভূরাজনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তার করতে এখন আফগানিস্তানে নতুন পরাশক্তি চীন ও রাশিয়ার প্রভাব দেখা যেতে পারে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে আফগানিস্তানের এ পরাজয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে, তেমনটি ভাবার কারণ নেই। ফলে এই পুরো অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতাও হয়তো আমরা সহসাই দেখব। চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও এখানে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে। আফগান পরিস্থিতি অতীতের চেয়ে আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি। বিশেষ করে পরাশক্তিগুলো যখন আফগানিস্তান নিয়ে খেলছে, নিরাপত্তা পরিষদে ‘ভেটো’ ক্ষমতার কারণে জাতিসংঘ দেশটির ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার এ সময়ে বাংলাদেশকে ভেবেচিন্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আফগানিস্তানে সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সেখানে আবার গৃহযুদ্ধ দেখা দেয় কিনা- তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। পরাশক্তিগুলোর ভূমিকাই বা কী হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। আগামী এক মাসের মধ্যে দেশটি খাদ্য সংকটে পড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে জাতিসংঘ। ব্যবস্থা না নিলে সেখানে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন অভুক্ত থাকবেন। আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার পরে তালেবান এখন সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে। তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে বিশ্বে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলে বিদেশ থেকে খাদ্য সহায়তা আসবে না। ইতোমধ্যে দেশের ভেতরের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে। খাদ্যসামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশ ও পেট্রলের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। সরকারি পরিষেবাগুলো কাজ করছে না। সরকারি কর্মীরা তাদের বেতনও পাচ্ছেন না। তালেবান এখনো সরকার গঠন করেনি বলে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে আফগানিস্তান পুনর্গঠন মোটেই সম্ভব হবে না। সংকট দিনের পর দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বাড়বে বৈ কমবে না। শান্তির পরিবর্তে অশান্তি, অরাজকতা, হানাহানি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও সহিংসতা বাড়বে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে দেশ ও আফগান জনসাধারণের স্বার্থে উদার ও মানবিক হওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। অন্যথায় আফগানিস্তানসহ আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সুদূরপরাহত। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App