×

জাতীয়

ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি : ১২ মামলা তদন্তে ঝুলে আছে সাড়ে তিন বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৭ এএম

ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি : ১২ মামলা তদন্তে ঝুলে আছে সাড়ে তিন বছর

ফাইল ছবি

প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় অতিবাহিত হলেও ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় করা এক ডজন মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করাও সম্ভব হয়নি। কবে চার্জশিট দেয়া হবে তাও জানাতে পারছেন না কেউ। এ পরিস্থিতিতে ঝুলে থাকা এসব মামলার তদন্ত শেষ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় চার্জশিট দাখিল করলেও সংশ্লিষ্ট আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে রয়েছে। অথচ সংস্থাটির আইনে যে কোনো মামলা দায়েরের পরবর্তী ৬ মাসের (১৮০) মধ্যে তদন্ত শেষ করার বিধান রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয় নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংককে। অনুমোদন নিয়ে কার্যক্রম শুরুর পরই ব্যাপক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির অডিট ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। পরে বাবুল চিশতী ও ছেলে রাশেদ চিশতীসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যাংকারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ১৬টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে তিনটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। তবে এ দুটি মামলাও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়েই ঝুলে রয়েছে। বাকি ১৩টি মামলায় গত সাড়ে তিন বছর সময় নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়েও ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করতে পারেনি দুদক।

এদিকে ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী, ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম এবং আইটি বিভাগের প্রধান ও ইভিপি মো. শাহ আজমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ (স্থগিত) রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে তাদের তিনজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এছাড়া প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায়ও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত মাহবুবুল হক চিশতীর সুপারিশেই। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তারা নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।

সূত্রমতে, দুদকের মামলায় বাবুল চিশতী ও তার ছেলে রাশেদ চিশতী ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল থেকে কারাগারে আছেন। রাশেদ চিশতীর বিরুদ্ধে ঢাকায় চারটি এবং টাঙ্গাইলে একটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের ১৮ ও ১৯ মে ঢাকার চারটি মামলায় এবং ২৭ মে টাঙ্গাইলের মামলায় জামিন পান তিনি। এর বিরুদ্ধে দুদক হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করে। এরপর ঢাকার তিনটি মামলায় হাইকোর্ট রাশেদুল হকের জামিন বহাল রাখলেও তার বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি শেষে গত ১ জুন তার জামিন বাতিল করে অর্থ আত্মসাতের মামলা বিচারিক আদালতকে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।

এর আগে ২৭ মে রাশেদ চিশতীর জামিন শুনানিতে চিশতী পরিবার সম্পর্কে আপিল বিভাগ বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ও তার পুরো পরিবার ফৌজদারি অপরাধে জড়িত। মাহবুবুল হক চিশতীই মূল অপরাধী। মামলার নথি থেকে দেখা যায়, অপরাধ কার্যক্রমে তিনি তার পুরো পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করেছেন। রাশেদ চিশতীর আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, আপনারা এখনো প্রমাণ করতে পারেননি এই অর্থের বৈধ উৎস কী।

দুদক সূত্র জানায়, বাবুল চিশতী ও রাশেদ চিশতী ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে কৌশলে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব টাকায় কেনা স্থাবর সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। আদালতের নির্দেশে এসব সম্পত্তি ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত সম্পত্তির বেশির ভাগই বাবুল চিশতীর পরিবারের সদস্যদের নামে। দুদকের দায়ের করা ১৬টি মামলায় বাবুল চিশতীকে আসামি করা হয়। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা তুলে নেয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে করা মামলায়ও আসামির তালিকায় বাবুল চিশতীর নাম রয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী রোজী চিশতী, ছেলে রাশেদ চিশতী, মেয়ে রিমি চিশতী, পুত্রবধূ (রাশেদ চিশতীর স্ত্রী) ফারহানা আহমেদ ও তার শ্যালক মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। তদন্তে বাবুল চিশতী পরিবারের সব সদস্যের বিরুদ্ধেই অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ব্যাংক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা রাশেদ চিশতী তার বিরুদ্ধে থাকা ৫টি মামলাতেই নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন। ভার্চুয়াল আদালতের ফাঁকফোকরে তার জামিন হয়েছিল। সে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে আমরা জানতে পেরে উচ্চ আদালতে আপিল করে তার জামিনাদেশ ঠেকিয়ে দেই। রাশেদ চিশতীর জামিন পাওয়া প্রতিটি মামলায় হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ইতোমধ্যে তার জামিন বাতিল করা হয়েছে। বিচারিক আদালতকে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্নীতির এত বড় মামলায় আসামিরা কোনো অবস্থাতেই যেন ছাড়া না পায়, আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি।

অর্থপাচার মামলাগুলো অত্যন্ত সেনসিটিভ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংক খাতের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা হলো ফারমার্স ব্যাংকের দুর্নীতি। এই ব্যাংকে এতটাই দুর্নীতি হয়েছে যে, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সরকারকে ব্যাংকটির নামই পরিবর্তন করতে হয়েছে। যেটি এখন পদ্মা ব্যাংক নামে পরিচিত। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটিকে সচল রাখতে সরকার পরবর্তীতে বিভিন্ন খাত থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে তহবিলেরও জোগান দিয়েছে। আর ব্যাংকের এই দুরবস্থার জন্য যারা দায়ী তারা যদি মামলার এ পর্যায়ে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়, সেটি হবে দুঃখজনক। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকটি কিছু লোক দুর্নীতি করে ডুবিয়েছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আশা করছি, তারা এ বিষয়ে তৎপর থাকবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App