কাবুলিওয়ালার আফগান, তালেবানের অর্থটান
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:০৯ এএম
যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে কানাকড়ির বড়াইও ছিল আফগানদের। বাংলাদেশসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশে ঋণ, সুদ, তথা ব্যাংকিং ধারায় তারাই ছিল বেশি আগুয়ান। কাবুলিওয়ালাদের নিয়ে কত উপাদান রয়েছে আমাদের সাহিত্য, নাটক, সিনেমায়! সেই কাবুলিওয়ালা মানে কাবুলের কোনো মহাজন। আর কাবুল মানে আফগান। চরম অর্থসংকটের মধ্যে সেই আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতার অভিষেক। তার ওপর খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যসংকট। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যমূল্যেরই ঊর্ধ্বগতি। এরই মধ্যে দেশটিতে খাবারের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। পেট্রলের দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় তহবিলের অবস্থা গুরুচরণ। এছাড়া দেশের বাইরে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব্দ হওয়া ১০০ কোটি ডলারে শিগগিরই হাত দিতে পারছে না তালেবানরা। দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তালেবানের সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি সচল করা। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আলকায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ায় আফগানিস্তানে বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতা হারিয়েছিল তালেবান। এর পর থেকে প্রত্যন্ত ও পাহাড়ি এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে আফগান বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের বিদেশি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে তালেবান যোদ্ধারা। পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে দুই দশক পর তারা অনেকটা ম্যাজিকের মতো উতরে ওঠে। ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে যাওয়ার পর দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এখন অর্থসংকটের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কীভাবে খেই রাখবে আফগানিস্তানের নতুন সরকার- তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। পরিস্থিতি সুখকর বার্তা দিচ্ছে না। দেশটির গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ শহরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছে। তালেবানের পক্ষ থেকে আফগান নাগরিককে বাড়ি ফিরে দেশ পুনর্গঠনে সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষাসহ তালেবানের আগের সরকারের চেয়ে ‘নরম’ অবস্থানের কথাও বলা হয়েছে। তবে তারা এটাও বলেছে, তালেবান শাসনে সবকিছু শরিয়া আইনেই হবে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর কট্টর ‘শরিয়া আইনে’ পরিচালিত তালেবান সরকারের আমলে নারীদের শিক্ষা এবং চাকরিতে নিষিদ্ধ ছিল। এবার খানিকটা ছাড় দিয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নারী না রাখলেও প্রশাসনে রেখেছে। তালেবান নেতারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার আহ্বান জানালেও সাড়া বড় দুর্বল। বিভিন্ন দেশ আরো অপেক্ষা করতে চাইছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে আরো সময় নেয়ার কৌশল প্রায় সবার। তাড়াহুড়া করতে চায় না বলে স্পষ্ট করেই জানিয়েছে ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকায় ইসলামপন্থি এ দলটি এভাবে ক্ষমতার দখল নেয়ায় চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ইউরোপিয়ানদের। তালেবানদের মতো কোনো সংগঠনের কাছে এভাবে রাষ্ট্র যদি হুমকি বা বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে ইউরোপিয়ান অনেক দেশের। চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ছাড়া বাদ বাকি দেশগুলোর মন-মর্জি প্রায় এমনই। ২০ বছরের যুদ্ধকালে বিদেশি সেনাদের সঙ্গে কাজ করা সব আফগান নাগরিককে তালেবানদের ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার কার্যকারিতা বাস্তবে কতটা ফলবে, তা অবশ্যই রাষ্ট্রগুলোর সময় নিয়ে দেখার বিষয়। রাষ্ট্র কেন, বিশ্বসভা জাতিসংঘও উদ্বিগ্ন আফগানিস্তান নিয়ে। আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘ তার বৈশিষ্ট্য মতো সবাইকে উদার হতে বলেছে। আবার দেশটিতে খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে মাসখানেকের মধ্যেই তা প্রকট হবে। এ সময় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রতি তিনজনে একজন। সতর্কতাটা ভয়ংকর। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়ক রমিজ আলাকবারভ বলেছেন, দেশটির অর্ধেকের বেশি শিশুকে পরের বেলা খাবারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯.৫ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্র আটকে দেয়ার পর সাহায্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি, কানাডাসহ আরো অনেক ইউরোপীয় দেশ। দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর দুর্বল অবকাঠামোর আফগানিস্তানের জন্য এটি বড় সংকটেরই পূর্বাভাস। পশ্চিমারা যখন মুখ বাঁকা করে চেয়ে আছে তখন তালেবানকে কাছে টানছে প্রতিবেশী চীন। মন্দের মধ্যেও আরেকটি ভালো খবর হচ্ছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন আফগানিস্তানে মানি ট্রান্সফার শুরু করেছে। এর আগে গত ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখলের পর সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি। আফগানিস্তানে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের অধিকাংশ ব্যবসা নিম্ন আয়ের পরিবারকেন্দ্রিক। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠান এবং আফগানিস্তানে তাদের পরিবারগুলো এই অর্থ দিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সেবা শুরুর মধ্য দিয়ে যেসব পরিবার রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে তারা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। আফগানিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি ও কৃষি থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত ও আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশ তাদের বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। এ দেশগুলোতে আফগানিস্তান থেকে শুকনো ফল ও মসলাসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। যুদ্ধের বাহাদুরি করলেও আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক অবস্থা করুণ। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী ৯০ শতাংশ আফগান সরকার নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। যাদের আয় দৈনিক দুই ডলারেরও কম। বিশ্বব্যাংকের ভাষায়- দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর এবং সাহায্যনির্ভর। অথচ এক সময় উল্টো তথ্য প্রচার হয়েছে। তালেবানদের কাছে টাকার খনি আছে, এমন কথাও প্রচার হয়েছে। বাস্তবটা ভিন্ন। ১০ বছর আগে তালেবানের যোদ্ধা ছিল ৩০ হাজার। কিন্তু ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে সংখ্যাটি ১ লাখে দাঁড়ালেও ভেতরের অবস্থা ছিল লুকানো-চাপানো। জাতিসংঘের হিসাবে বলা হয়েছিল, ২০১১ সাল থেকে তালেবানের বার্ষিক আয় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। বিবিসির অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে এসে তালেবানের বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এত টাকা তারা পেল কোথায়? কে দিল? স্পষ্ট তথ্য বা জবাব নেই। এক সময় বলা হতো, মাদক ব্যবসা, খনিজসম্পদ পাচার, বিদেশি অনুদানসহ নানা উপায়েই তাদের অর্থ আসে। সেক্ষেত্রে নাম এসেছে পাকিস্তান, ইরান, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের। তা নিয়েও পারস্পরিক বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে খনিজসম্পদ থেকে অর্থ আহরণের তথ্য অনেকটা পরিষ্কার। দক্ষিণ আফগানিস্তানে তালেবান অধিকৃত অঞ্চল থেকে নিকেল, ট্যাংস্টেন, সোনা, মূল্যবান পাথর ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করে থাকে তারা। দেশটির বিভিন্ন খনিজ সাইটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা বৈধ এবং অবৈধ খনিজ উত্তোলন প্রকল্প থেকে অর্থ আয় করে থাকে তালেবান। ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের অ্যানালিটিকাল সাপোর্ট এন্ড স্যাংকশনস মনিটরিং টিমের তথ্য হচ্ছে- দক্ষিণ হেলমন্দ প্রদেশের ২৫ থেকে ৩০টি অবৈধ খনির অপারেশন থেকে বছরে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করে তালেবান। তালেবানের সঙ্গে চীনের বিশেষ সম্পর্কের নেপথ্যে এটি অন্যতম কারণ। গত কয়েক দশকেও কৃষি খাত ছাড়া নতুন তেমন কোনো উৎপাদনশীল খাত দাঁড়ায়নি, যা আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী রাখবে। চার কোটি মানুষের দেশটিতে মাথাপিছু দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৫০০ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক নিচে। সাক্ষরতার হার মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ। কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের প্রয়োজন মেটাতে যে শিক্ষাব্যবস্থা দরকার দেশটিতে তা নেই। ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে বর্তমানে ৩৭ লাখ শিশু রয়েছে, যারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এ শিশুদের ৬০ শতাংশ মেয়ে। দেশটির বিভিন্ন স্কুলে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৪৮ শতাংশই শিক্ষাদানে যথেষ্ট যোগ্য নন। অন্যের ওপর নির্ভরশীল রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতি সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তানকে কোথায় নেবে, অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। দেশটিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও কম। চলমান অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশটিতে ঝুঁকবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বিদেশি সাহায্যের জোগান কেমন হবে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। আয়রন, কপার, লিথিয়াম, কোবাল্টসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ তালেবানরা কতটা কাজে লাগাতে পারবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]