×

মুক্তচিন্তা

আফগানিস্তান ইস্যুতে সতর্কতা জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:১০ এএম

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে আঞ্চলিক, ভূ-রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়েও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চিন্তার পরিবর্তন ঘটবে। ভবিষ্যতে সেসব চিন্তভাবনা স্পষ্ট হবে। ভূ-রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাহ্য রূপ ব্যতীত সাধারণ মানুষ হিসেবে ভেতরকার গভীরতা আমাদের পক্ষে অনুমান অসম্ভব। তবু তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করলে আমাদের মনটি মুক্ত হয় না। তাই বিশ্বব্যাপী নানারূপ ঘটনায় আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষেরও কোনো না কোনো প্রতিক্রিয়া থাকে। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে সেরূপই প্রতিক্রিয়া এটি। ভূ-রাজনৈতিক গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এ লেখায় খোঁজা যথার্থ হবে না। একজন সাধারণ মানুষের মানবীয় কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরাই এ লেখার অভিপ্রায়। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে আফগানিস্তানের úূর্ণ দখল নেয়া তালেবানদের। দখল নেয়ার পর থেকে ‘অল্প সময়ের মধ্যে’ সরকার গঠন করবে বলে বারবার ঘোষণাও দিয়েছে। গত শুক্রবার (০৩/০৯/২১) জুমার নামাজ শেষে নতুন সরকারের চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে বলেও সর্বশেষ শুনেছিলাম। তবে এ লেখা প্রকাশের আগেই হয়তো আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠিত হতে পারে। দীর্ঘ দোলাচলে তালেবানদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কিছুটা প্রকট হয়েছে। দেশটি গত দুই সপ্তাহ ধরে কার্যত সরকারহীন তো বটেই অনেকটা যেন নিয়ন্ত্রণহীনও রয়েছে। এর আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে যখন একের পর এক বিভিন্ন শহরের দখল নিচ্ছিল তালেবানরা, তখন কিছুটা হলেও মনে হয়েছিল তাদের সাংগঠনিক কাঠামোর শক্তিশালী অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের আক্রমণের শক্তিশালী রূপে ভীত হয়েই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়েছেন। তালেবানরা একের পর এক শহর দখল শেষে রাজধানী কাবুলও দখল করেছে। দখল এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বিগত কয়েক সপ্তাহে তারা একটি সরকার কাঠামো দাঁড় করতে পারেনি! এটি কি তাদের ব্যর্থতা না ‘ধীরে চলো নীতি’ তাও বোঝা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও শৃঙ্খলার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। সরকারহীনতায় এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আবার আইএস আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ১৭০ জন মানুষকে হত্যার দায় স্বীকার করে নিজেদের অস্তিত্ব ও কৃতিত্ব জাহির করেছে! নিহতদের মধ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন ১৩ জন। আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মার্কিনিদের জন্য এ হত্যাকাণ্ড একটি ট্র্যাজিক আবহের সৃষ্টি করেছিল। সাফ কথা হচ্ছে, আফগানিস্তানের সর্বস্তরে এখন বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সামাজিক, আর্থিক, এমনকি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খলা সেখানে জেঁকে বসেছে। ফলে দেশটির সামনে আগামী দিনগুলোতে যে বড় রকমের অনিশ্চয়তা অপেক্ষা করছে তাই যেন ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তালেবানদের রাজনৈতিক সংগঠনটি শক্তিশালী হলেও যে কাঠামোবদ্ধ নয় তা এখন বিশ্ববাসীর কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা চীনের সমর্থন পেয়েছে, সমর্থন পেয়েছে মার্কিন প্রশাসন এবং রাশিয়ারও। তাদের দেয়া নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সব মার্কিন যোদ্ধার আফগানিস্তান ত্যাগও সম্পন্ন হয়েছে। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দুটি দেশ পাকিস্তান এবং ইরান তালেবান নিয়ন্ত্রিত সরকার গঠন ও তাদের সহায়তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। তালেবানরা এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় বর্তমানে কতটুকু সক্ষম সে প্রশ্নগুলোও সামনে আসছে। সম্ভবত সেজন্যই কোয়ালিশন সরকার গঠনের দিকেই তালেবানদের বেশি আগ্রহ বলে নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী কোয়ালিশন সরকারের প্রতি তালেবানদের আগ্রহের অন্তত দুটি কারণ আমরা সহজে বুঝতে পারি। এর একটি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা, যা ইতোমধ্যেই ব্যক্ত এবং অপরটি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দেশে আপাত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। কিন্তু তালেবানদের সম্পর্কে আমাদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ কাজ করে। সে দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদেরও সন্দেহের অবসান ঘটেনি। এককথায় সাধারণের মধ্যে তারা ‘পরিপূর্ণ বিশ্বাস’ অর্জন করতে পেরেছে বলে হয় না। আফগান নারীরাও তালেবান সরকারের পূর্ণ আস্থাশীল নন। তারাও গত শুক্রবার সমান অধিকারের দাবিতে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। উপরন্তু আফগানিস্তানে ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভেদাভেদও প্রচুর। এছাড়া অন্তত ১৪টি এথনিক জাতি-উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যকার ভেদাভেদ তো আছেই। তালেবানরা সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিও হয়তো তাদের সরকারে অন্তর্ভুক্ত করবে। ফলে সে ক্ষেত্রেও কিছু সময় প্রয়োজন। তবে সেখানে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা বা জাতীয় সংহতি নিশ্চিত করাও কঠিন। সাম্প্রতিক পরিবর্তিত অবস্থায় আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনার কোনো শক্তিশালী আহ্বান এখনো শোনা যায়নি। অর্থাৎ আফগান-ঐক্যের আদর্শ এখনো পরিষ্কাররূপে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি। তালেবানরা ইতোমধ্যে ‘ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তান’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছে। সুতরাং আফগানিস্তানে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদূরপরাহত। যদিও এক শ্রেণির বিশ্লেষক বর্তমানের তালেবান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ২০ বছর আগের তালেবান আর এই তালেবানদের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। এরা বৈশ্বিক পরিবর্তনের স্রোতধারাকে মেনে নিয়ে নিজেদের পুনর্গঠিত করেছে। বিশেষজ্ঞদের এরূপ পর্যালোচনা আমাদের কাছে ‘একাডেমিক’ বা তত্ত্বীয় মাত্রই মনে হয়েছে। বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম থেকে যা উপলব্ধি করা যাচ্ছে তা একেবারেই ভিন্ন। দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার ছত্রছায়ায় থেকে কিংবা উভয় দেশের আধুনিকতার প্রভাবে বিগত কয়েক যুগ ধরে আফগানিস্তানে যে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে তাদের শিক্ষা-দীক্ষায়ও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। এই প্রজন্মের কাছে তালেবানরা এখনো বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারছে না। নানা কারণে তারা তালেবানদের মোটেই বিশ্বাস করেন না। আবার তালেবানদের নারী নীতি বিষয়েও ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে যে বার্তা রটেছে তাতে নতুন প্রজন্মের আশ্বস্ত হওয়ার বা স্বস্তি পাওয়ার কোনো অবকাশ আছে বলে আমাদেরও মনে হয় না। নারী-পুরুষ একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পারবে না, কর্মস্থলেও একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। ‘আপাতত নারীরা ঘরে থাকুক’ বলে তারা ইতোমধ্যে যে বার্তা দিয়েছে সেটিই যে তাদের মৌল উদ্দেশ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার ‘এখনই উচ্চ পর্যায় নয়, নারীরা কেবল নিম্ন পর্যায়ের কিছু ক্ষেত্রে কাজ করতে পারবে’ এমন ঘোষণায়ও তাদের স্পষ্ট অবস্থান বোধগম্য হচ্ছে না। পূর্ব-অবয়বে তারা নতুনভাবে প্রকাশিত হবে বলেই ধরে নেয়া যায়। সুতরাং আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পরিবর্তনে বিশ্ববাসী এবং সে দেশটির সাধারণ মানুষের আশার আলোটুকু যে অনেকটাই নিষ্প্রভ তা সহজে অনুমেয়। আমরা চাই একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠিত হোক আফগানিস্তান। তালেবানরা রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পূর্বে যখন একে একে দূরবর্তী শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল তখন আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে অতি উৎসাহ দেখা গিয়েছিল। বাংলাদেশের কিছু উৎসাহী লোক তালেবানদের সঙ্গী হওয়ার লক্ষ্যে দেশ ছাড়ারও পরিকল্পনা করেছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা জালে এই উৎসাহীদের কেউ কেউ আটকও হয়েছিলেন। বাংলাদেশে অতি উৎসাহী এই লোকদের সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে। তখন প্রায়ই তারা এমন সেøাগান দিয়ে বেড়াতেন যে, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’! তালেবানদের বর্তমান উত্থানে এই দলভুক্তরা আশান্বিত ও উৎসাহী হবেন সন্দেহ নেই। আমরা হতাশ বোধ করছি নানা কারণে। প্রথমত এই ভেবে যে, আফগানিস্তানের বর্তমান সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে সেখানে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। খাদ্য, স্বাস্থ্য, অর্থ, শিক্ষা প্রভৃতি খাত মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। আরো হতাশ বোধ করছি আফগানিস্তানে কট্টর, উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া ব্যাপক পরিমাণ সমরাস্ত্রের কতটুকু মানবিক ব্যবহার নিশ্চিত করে সে আশঙ্কাও আমাদের তাড়িত করে। আগামী দিনের আফগানিস্তান পুনর্গঠন নিয়ে আমাদের হতাশা যে দীর্ঘমেয়াদি হবে সে আশঙ্কা থেকেও মন মুক্ত হতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে গভীর এক সংকটের আবর্তে দেশটি পতিত হতে চলেছে, মহাসংকটের আবর্তে পতিত হতে চলেছে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়াও! কবে সেখানকার সাধারণ মানুষের মুক্তি অর্জিত হবে তা কেউ জানে না। আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের হতাশার আরেকটি জায়গা হলো দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমাদের দেশ পর্যন্ত অনুভূত হবে। সেই শঙ্কা থেকে বাংলাদেশকে সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে সর্বক্ষণ। কারণ আমাদের দেশে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো নানা ইস্যুতে তালেবানদেরই সমমনা। তাদের অনুসৃত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে এরাও বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করবে না! সেজন্য সর্বক্ষণ গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে সন্দেহভাজন গোষ্ঠীর ‘সাইবার’ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সর্বোচ্চ সতর্কতাই সাধারণের প্রত্যাশা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুরক্ষায় প্রচলিত শিষ্টাচার হিসেবে রাষ্ট্রীয় অবস্থান ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যে কোনো দেশে জনগণের সমর্থিত যে কোনো সরকারকেই বাংলাদেশ সমর্থন জানায়, সে আফগানিস্তান হোক বা অন্য কোনো রাষ্ট্র। জনগণের সমর্থন নিয়ে তালেবানরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের কোনো সংকট নেই। সংকট সৃষ্টি হবে তখনই যখন দেখা যাবে ব্যাঙের ছাতার মতো দেশব্যাপী গজিয়ে ওঠা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তালেবানি জিকিরে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। এ বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতিসহ সবসময় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে বাংলাদেশকে।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App