×

মুক্তচিন্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতি : পরিমল নায়ক, নায়িকা সুদেব

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৯ এএম

পরিমল রায় ১৯২৭ সালে আঠারো বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জগন্নাথ হলে সংযুক্ত হয়েছিলেন। সুদর্শন পরিমল রায়কে নাটকে পেয়ে বসল। নাট্যকার ‘কুখ্যাত আধুনিক সাহিত্যিক’ বুদ্ধদেব বসু। তার ভূমিকা নায়কের কিন্তু নায়িকার ডায়লগও তাকে মুখস্থ করতে হলো, কারণ তিনিই নাটকের নায়িকাকে প্রম্পটিং করবেন। বুদ্ধদেবের নাটক নতুন ফ্যাশনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দ্বিতীয় নাটকটিতে এমন জায়গায় যবনিকা পড়ল যেখানে নায়ক-নায়িকার প্রেম কেবল শুরু হয়েছে। নায়িকা চরিত্রে সুদেব বসু, বুদ্ধদেবের ভাই, একেবারে সহোদর, তখন ঢাকার মঞ্চের সেরা নায়িকা। প্রেমের শুরু, ‘বিবাহের তখনও বহু বিলম্ব। অভিনয় শেষে যখন ড্রপসিন পড়িল তখনও মিলনায়তনে কাহার উঠিবার নাম নাই। ড্রপসিনের পিছনে আমরা হতভম্ব। সুদেব বসু নায়িকা সাজিয়েছিল, সে দৌড়াইয়া আসিয়া আমাকে বলিল, সর্বনাশ হইয়াছে। বলিলাম, কী ব্যাপার? সুদেব বলিল, উহারা আমাদের বিবাহ না দেখিয়া উঠিব না। সে এক মহাহাসির কাণ্ড। অবশেষে প্রফুল্ল গুহ মহাশয় রঙ্গমঞ্চের পর্দার ফাঁকে মুখ বাহির করিয়া ঘোষণা করিলেন, নাটক শেষ হইয়াছে, আপনারা এখন উঠিতে পারেন।’ ১৯৩১ থেকে ১৯৪৫ চৌদ্দ বছর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে পরিমল রায় ভারতে ফিরে গেলেন। কিন্তু কেন? একদা রমনামুগ্ধ ছাত্র পরিমল পরিণত বয়সে দেখলেন, ‘রমনার সূর্যাস্তশোভিত প্রান্তর শ^াপদসঙ্কুল হইয়া উঠিয়েছে’। মহাযুদ্ধ জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে, মহার্ঘ ভাতার জন্য দরবার করেছেন, বেতন বাড়াবার দাবি জানিয়েছেন, চল্লিশ টাকা মণ চাল কিনেছেন, নিজের বাড়ি সৈন্যদের ভাড়া দিয়ে সস্তার বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। এই দুর্ভাগ্য ঢাকায় বসবাসের জন্য নয়, সভ্যতার মহাসংকটের কারণে। অথচ শুরুটা কত আনন্দপ্রদ ছিল; সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রমনার সাত সমুদ্র ছড়াইয়া ছিল। ‘চামারি (হাউস) হইতে নীলক্ষেত তরুণ বিদ্যার্থীর বিপুল সাম্রাজ্য, রীতিমতো দিগি¦জয়ে বাহির হইবার আমন্ত্রণ... যাহা দেখি তাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাই। কমনরুম দেখিয়া বিস্ময় মানিলাম, লাইব্রেরিতে ঘুরিয়া অভিভূত হইলাম, সুবেশ অধ্যাপকদের দেখিয়া উচ্ছ্বাসিত হইলাম, দীর্ঘ করিডোরগুলো রুদ্ধশ্বাসে হাঁটিয়া ফিরিলাম, ঘোমটাপরা তরুণী বিদ্যার্থিনীদের দেখিয়া চক্ষু কৌতূহলী হইয়া উঠিল।’ তবুও ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হলো।

নবযুগের কর্ডোভা কবি জসীমউদ্দীনের মুসলিম হল কবিতাটি হালে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে, কিন্তু এক সময় জনপ্রিয় ছিল : মুসলিম হল, মুসলিম হল এ নবযুগের কর্ডোভা তুমি আলহামরার ছায়া শীতল। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সময়ের নিষ্ঠাবান আবাসিক ছাত্র মাহবুবুর রহমান (১৯২০-১৯৯৩); স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি ঢাকা বিভাগের প্রথম কমিশনার; তারপর ১৯৭৫ পর্যন্ত তিন বছর সরকারের সংস্থাপন সচিব। মুসলিম হল এ দেশে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তিনি মনে করেন ব্যক্তি জীবনের বিকাশেও এ হলের ভূমিকা স্মরণীয়। হলের ভেতরই ছিল মসজিদ। আমরা এই মসজিদে জুমা, পাঁচওয়াক্ত ও তারাবির নামাজ পড়তাম... সেকালে আরবি খোতবা পড়ার আগে বাংলা অর্থ বলে দেয়া হয় না। কিন্তু মরহুম ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়তেন এবং নামাজের আগে বক্তৃতা করতেন’- আর তার সারগর্ভ বক্তৃতার কারণে অনেকে জুমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তিনি হলকে দেখেছেন ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে। তিনি অকপটে একটি প্রতিশোধমূলক দাঙ্গায় অংশগ্রহণের জন্য ছুটে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন : ‘মুসলিম হলের কথা বলতে গিয়ে তখনকার এক দুঃখজনক ঘটনার কথা মনে পড়ে। ঢাকায় তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে।... আমাদের হলের ছাত্র মোতাহার হোসেন এই দাঙ্গার শিকার হয়। তাকে জগন্নাথ হলের সামনে ছুরিকাঘাত করা হয় এবং অকুস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এই খবর হলে পৌঁছানো মাত্র মুসলিম হলের ছাত্ররা উন্মত্ত হয়ে পড়ে। আমার হাতেও কি একটা অস্ত্র ছিল। আমরা হিন্দু হলগুলো আক্রমণ করার জন্য ধাবিত হই।’ হাঙ্গামার খবর অচিরেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিকট পৌঁছে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে কমিশনার, ভিসি ও পুলিশ ফোর্স এসে পড়ল এবং তারা আমাদের এগোতে দিলেন না।

জিল্লুর রহমান-জামালউদ্দীন প্যানেল রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে ১৯৫২-এর সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি প্রথম পর্বে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪-তে এমএসসি পাস করে বেরোবার অন্তর্বর্তীকালে শিক্ষাবিদ মুহম্মদ এলতাসউদ্দিন ঠাঁই পেলেন ফজলুল হলে, পশ্চিম দিকের ডব্লিউ ৮ নম্বর রুমে। তখন তার হলমেটদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি, ছাত্রনেতা স্বাধীনতা আন্দোলনকালের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, আমলা ও মন্ত্রী এম কে আনোয়ার, পরবর্তীকালের ভাইস চ্যান্সেলর এমাজউদ্দীন আহমদ, জামালউদ্দীন আহমদ (৮০-এর দশকের শুরুতে উপ-প্রধানমন্ত্রী), আমলা শামসুল হক চিশতি, আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু, রাজনীতিবিদ আফসার আহমদ সিদ্দিকী, সচিব গোলাম রব্বানী প্রমুখ। এলতাসউদ্দিনের বর্ণনায় উঠে এসেছে ফজলুল হক মুসলিম হলের ১৯৫২-৫৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের জন্য দুটি প্যানেল দাঁড়িয়ে গেল : একটিতে ভিপি পদের জন্য জিল্লুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে এমাজউদ্দীন আহমদ। অপর প্যানেলের নেতৃত্বে জামালউদ্দীন আহমদ। দুই প্যানেলই বিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। এক সময় গাজীউল হক ও তাজউদ্দীন মনে করলেন হলের ভেতর বিরুদ্ধ ধারা প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। তারা এমাজউদ্দীন আহমদকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করলেন এই প্রতিশ্রুতিতে যে পরের বছর তাকেই ভিপি করা হবে। তিনি সম্মত হলেন। শেষ পর্যন্ত একটি প্যানেল হলো : জিল্লুর রহমান-জামালউদ্দীন প্যানেল, এই প্যানেলকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। পরের বছর ভিপি হলেন এমাজউদ্দীন আহমদ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এমাজউদ্দীন সরে গিয়ে বিরোধিতা মোচনের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। হলের ভেতরের রাজনীতি ও নেতৃত্ব নিয়ে তাজউদ্দীন মাথা ঘামাননি, তিনি ততদিনে কেন্দ্রীয় রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি কাপাসিয়া থেকে প্রার্থী হন এবং জয়লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যিক মনোজ বসু কলকাতা থেকে ঢাকায় এলেন, লিটন হলের ছোট মিলনায়তনে তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হলো। তিনি লেখক জীবনের বিড়ম্বনার কাহিনী শোনালেন, এলতাসউদ্দিনসহ ফজলুল হক হলের ছাত্ররা সাগ্রহে তার কথা শুনলেন।

ভিসি যখন ভিপি : নায়িকা যখন নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১তম ভাইস চ্যান্সেলর (১৯৯২ থেকে ১৯৯৬) এমাজউদ্দীন আহমদ (১৯৩৩-২০২০) ১৯৫৩-৫৪ সালে ফজলুল হক হলের ভিপি নির্বাচিত হলেন। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ও বাড়াতে নতুন কিছু তো করতেই হয়। তিনি ঠিক করলেন বার্ষিক নাটকে নারী চরিত্রে শাড়ি পরিয়ে ছাত্রদের আর নামাবেন না, ছাত্রীকেই মঞ্চে নামতে হবে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ঢাকার মঞ্চে বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে মেয়েদের মঞ্চে আসার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। ১৯৪০ সালে চালু করা হলটির নামও ছিল ফজলুল হক মুসলিম হল। এমাজউদ্দীন আহমদের কেবিনেটে তিনজন নারী সদস্যের একজন সাবেরা (অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের বোন, পরে সাংবাদিক কে জি মোস্তফার স্ত্রী) বেশ অনুরোধের পর নাটকে নামতে রাজি হলেন। ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর ছিলেন নাট্যকার নুরুল মোমেন, তিনিই এ উপলক্ষে নাটক লিখলেন ‘রূপান্তর’। প্রভোস্ট ডক্টর এম এন হুদা সাবধানী মানুষ, তিনি ভিপি ও নাট্য দলকে নিরুৎসাহিত না করে সতর্ক করলেন, বললেন ‘ঢাকাইয়া লোকজন তেড়ে আসবে না তো? সবদিক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছো তো? আমি এর দায়-দায়িত্ব নিতে পারব না।’ ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক হল মিলনায়তনের চারদিকে রীতিমতো প্রতিরোধ প্রহরা বসিয়ে, তার আগে পুরান ঢাকার কিছু বন্ধু ও স্বজন হাত করে নাটকটির মঞ্চায়ন করা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছর পর নায়িকা চরিত্রে দাড়িগোঁফ কামানো পুরুষ নয়, বাস্তবের নারী অভিনয় করলেন। নারী চরিত্রে নারী- এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যথালিঙ্গ নাটক। এমাজউদ্দীন লিখেছেন : আজও মনে আছে ওই নাটকের নাম ভূমিকায় ছিলেন আমার বন্ধুবর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শামসুল হুদা (গোলাম মোস্তফার বড় ভাই) এবং সাবেরা খাতুন।... শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রভোস্ট ড. হুদাও প্রশংসা করে বলেছিলেন, যা করলে নতুন প্রজন্ম তা অভিনন্দন জানাবে। এরপরই দাড়িগোঁফ কামানো নায়িকার দিন শেষ হলো, সত্যিকারের নায়িকার আবির্ভাব ঘটতে শুরু করল।

সান্ধ্য রোলকল ও দাবার বোর্ড হরণ সান্ধ্য রোলকলে ধরা পড়া গেলেন কাজী ফজলুর রহমান (পরবর্তীকালে সিএসপি সচিব এবং লেখক)। থাকতেন ওয়েস্ট হাউসে। হাউস টিউটর ডক্টর মফিজ আর তার সহকারী জব্বর সাহেব। তারা যা বলেন, সেটাই আইন, অমান্য করলে বড় খেসারত দিতে হয়। কাজী ফজলুর রহমান ১৯৪৯-১৯৫৩ বর্ষের ছাত্র, তার বিষয় পরিসংখ্যান, তিনি তার একদা সহপাঠী সাদেক খানের রুমে তার সঙ্গে দাবা খেলায় মগ্ন। জব্বর সাহেবের নির্দেশে দারোয়ান দাবার বোর্ড নিয়ে গেল আর দুজনকে জানিয়ে দিল কাল জব্বর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরদিন তাদের কিছু তিরস্কার জুটলেও দাবার বোর্ড ফেরত পেলেন, সে সঙ্গে নসিহত শুনে এলেন রাত ন’টা দাবা খেলার জন্য ভালো সময় নয়, ওটা পড়াশোনার সময়। হলে রাজনীতির দুটির ধারণ ছিল, একটি মুসলিম মতাদর্শী অন্যটি বামপন্থি কিন্তু তাদের কোনোটাই কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে সংগঠন ছিল না। যখন কাজী ফজলুর রহমান দুই বিছানার রুম পেলেন তার রুমমেট সৈয়দ ছিদ্দিক আহমদ তার উল্টো রাজনৈতিক আদর্শের- কিন্তু এতে প্রীতির সম্পর্ক কখনো ক্ষুণ্ন হয়নি। দুই হাউসের রান্নার জন্য ছিল এক অভিন্ন মেস কমিটি। পালা করে প্রতিমাসে একজনকে সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতে হয়। তার কাজ বাজার তদারকি, খাবারের মান ঠিক রাখা এবং বাজারের হিসাব খাতাপত্রে ঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা। তিনি যখন দায়িত্ব পেলেন হলের বাবুর্চির সঙ্গে বাজারে গিয়ে টের পেলেন দোকানিদের কাছে বাবুর্চির মর্যাদা ভিআইপির। এত বিশাল সংখ্যক ভোক্তার এক বেলার খাবারই তো অনেক- সেখানে সপ্তাহের কি মাসের খাবার যিনি নেবেন তিনি তো একাই শত লক্ষ্মীর শুভেচ্ছা বয়ে আনেন। দোকানদার যত্ন করে চা-বিস্কুট দিয়ে মেস কমিটির সেক্রেটারিকে ব্যস্ত রাখলেন। এটা বাবুর্চি ও সেক্রেটারি উভয়ের জন্যই স্বস্তিকর হলো। ১৯৫৩-এর নভেম্বরে এমএসসি পরীক্ষা দিয়ে হল ছাড়লেন কিন্তু বছর শেষ হওয়ার আগে আবারো ঢুকতে হয় ইস্ট হাউসের হাউস টিউটর হিসেবে। তবে এই অধ্যায়টি দীর্ঘ হয়নি। ১৯৫৪-তে গোটা পাকিস্তানে প্রথম হয়ে তাক লাগানো ফল দেখিয়ে তিনি সিএসপি হয়ে গেলেন।

জেঙ্কিন্সের পরামর্শ এস এম হলের ১৯৫৩-৫৪ সেশনের নির্বাচিত নির্বাহী পরিষদ প্রথামাফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর ওয়াল্টার অ্যালেন জেঙ্কিন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করল। জেঙ্কিন্স সাহেব ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের সদস্য। তিনি পরিষদ সদস্যদের তার বিশাল বাসভবনে (বর্তমান উপাচার্য ভবন) অভ্যর্থনা জানালেন এবং চায়ে আপ্যায়িত করলেন। তিনি কমিটিকে অভিনন্দন জানালেন এবং বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মিশন শিক্ষা। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকার জন্য তিনি বিশেষ পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, শিক্ষা শেষ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করো এবং কিছু টাকা কামাই করো। যদি রাজনীতিবিদ হতে চাও খুব ভালো- শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও টাকা নিয়ে রাজনীতিতে নামো, তাহলেই রাজনীতির মাধ্যমে দেশের সেবা করতে পারবে। তিনি রাজনীতির সর্বোত্তম মডেল হিসেবে এ কে ফজলুল হকের উদাহরণ দিলেন। তিনি পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করেছেন, আইন ব্যবসায় যোগ দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। ফজলুল হক সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করতেন, বলেছেন ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ভারতবর্ষের একজনেরও আছে। একমাত্র ফজলুল হক। ভাইস চ্যান্সেলর জেঙ্কিন্সের এই বিবৃতি সততার সঙ্গে প্রদত্ত। তিনি ফজলুল হককে সরকার পরিচালনায় এবং বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে দেখেছেন।Ñ এই বিবরণ দিয়েছেন ১৯৫৩-৫৭ শিক্ষাবর্ষের এস এম হলের আবাসিক ছাত্র এম নুরুন্নবী চৌধুরী (১৯৬০ সালের সিএসপি এবং সাবেক সচিব)। অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এস ভি আয়ার। মোট আটজন শিক্ষক তাদের কেউই প্রফেসর নন। অর্থনীতি অনার্সের জন্য নির্বাচিত ২৫ জনের একজন নুরুন্নবী; শিক্ষকদের অন্যতম এএনএম মাহমুদ ছাত্রদের তার শান্তিনগরের বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি তার আঙ্গুর বাগান দেখাবেন। তিনি সবাইকে আঙ্গুর খাওয়ালেন, টক, তবুও তারা আনন্দিত কেউ কেউ জীবনে প্রথম আঙ্গুর গাছ দেখলেন, এ মাটিতেও আঙ্গুর ফলানো সম্ভব, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উন্নত আঙ্গুরও ফলানো যাবে। ইংরেজিতে লিখিত তার স্মৃতিগ্রন্থে এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্সিভিটিজ বিশেষ করে খেলাধুলায় সেরা যে মুসলিম হল তা তুলে ধরেছেন; অ্যাথলেট আবদুল আলিমকে গ্রিক অ্যাথলেটদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৫৭-তে এমএ ফাইনাল দিয়ে আজিমপুর কলোনিতে প্রফেসর নুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তিনি বললেন, আগে কলেজ শিক্ষকতা শুরু করো, সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও, সিএসপি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করো। তিনিও ঠিক তা-ই করলেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App