×

মুক্তচিন্তা

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন পথে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৯ এএম

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসতে না আসতেই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তালেবানদের কাবুল দখলের ঘটনায় বিশ্ববাসী অনেকটাই হতচকিত। বিব্রত যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও তাদের মিত্ররা, রুষ্ট মার্কিন জনগণও। কেউই ভাবতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি যবনিকাপাত ঘটবে নাটকের। এর পরের ঘটনাও নিঃসন্দেহে করুণ, তড়িঘড়ি আফগান ত্যাগের হিড়িক পড়ল বিদেশি সেনা ও স্থানীয় সহযোগীদের। শোনা যায় এ দৃশ্য প্রভাব ফেলেছে আমেরিকার জনমতে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে। যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টআদর্শের- ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে, বাইডেন সে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছেন মাত্র। সবদিক বিবেচনায় বাইডেন খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলা যাবে না। কোভিডের ধাক্কায় বিপর্যস্ত তার সরকার পরিণতিহীন যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনকে আর যুক্তিযুক্ত মনে করেনি, সে কারণেই এই পিছটান হয়তো। যতদূর জানা যায়, শহরাঞ্চল ছাড়া গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আগেই হারিয়ে ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত আফগান সরকারি বাহিনী। এরপর চূড়ান্ত পরাজয় সময়ের ব্যাপার ছিল হয়তো। এ ঘটনা থেকে পরাশক্তির একটি শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, সেটি হলো কেবল অস্ত্রের জোরে সবকিছু হয় না, সফলকাম হওয়ার জন্য মনোজগতের পরিবর্তন আনতে হয় স্থানীয় ভিত্তি তৈরি দ্বারা। তেমন প্রচেষ্টা ছিল না বলে আফগানিস্তানে ব্রিটিশরা সফল হয়নি, লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়নও। আমেরিকাও পারল না। তাছাড়া আফগানিস্তান একটা ব্যতিক্রমী দেশ, এখানে বহু জাতিগোষ্ঠী বা বহু গোত্রের বসবাস। তারা একে অন্য থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র ভেবে অভ্যস্ত। হানাহানি লেগেই থাকে এ নিয়ে। প্রকৃতিও সেখানকার ভিন্ন ধাঁচের। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে মরুভূমি। একদিকে তুষারপাত, অন্যদিকে প্রবল উষ্ণতা। প্রকৃতির মতো মানুষও রুক্ষ অনুমান করি। বলা চলে সংঘাতের মধ্যে বসবাস তাদের। তালেবানরা বিপুল অস্ত্রশস্ত্রের মালিক। বিভিন্ন তথ্যমতে তাদের হাতে আছে ২০০০ সাঁজোয়া যান, ৪০টির মতো যুদ্ধবিমান। এসব জেনেও পানসির মতো কোনো কোনো প্রদেশে তালেবানরা প্রতিরোধের সম্মুখীন। কাজেই নতুন তালেবানি শাসনে শান্তি কতটা প্রতিষ্ঠিত হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ক্রমাগত দ্বন্দ্ব সংঘাত, সহিংসতা ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে দিন কাটছে আফগানদের। সুদূর অতীতের কথা যদি বাদ দিই তো দেখি অন্তত ৪০ বছর ধরে এ জাতির একটি বৃহৎ অংশ পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত নয় যারা তারাও সন্দেহাতীতভাবে শান্তিতে নেই। শরণার্থীর জীবন বিপুল মানুষের। ১৯৭৮ সালে তখনকার সময়ের দুই বৃহৎ পরাশক্তির একটি সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নেয়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়। বিশে^র বামশক্তির একটি অংশ এতে উল্লসিত হয়। আমাদের দেশেও এর সমর্থক দেখা যায়। জনভিত্তি ও জনসমর্থন ছাড়া যে বিপ্লব সফল হওয়ার মতো নয় এ সত্য বিস্মৃত হয়ে যান তারা। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার দশা হলো এরপর সে দেশে। মুজাহিদিন নামের একটি গোষ্ঠী সোভিয়েত তৎপরতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হলো। তারা ভাবাদর্শের দিক থেকে গোঁড়া মুসলিম, শরিয়াহ আইন ও ইসলামি এমিরেট প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। একেবারেই উল্টো দুই দর্শন মুখোমুখি সেবার। একপাশে উদারতা, অন্যপাশে চরম অনুদারতা। এই মুজাহিদদের ভেতর চরমপন্থিখ্যাত তালেবানদের শক্তি বৃদ্ধি পেল একপর্যায়ে, নেতৃত্ব চলে গেল তাদের হাতে। ১৯৯৬ সালে সোভিয়েত ও আফগান বাহিনীকে পরাভূত করে ক্ষমতা নিলো তালেবান বাহিনী। তখনকার প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রেখে তারা তাদের শাসনের ধরন জানান দিল। সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একসময় যেমন আমাদের দেশের বামশক্তির একাংশ উল্লসিত হয়েছিল, এবার উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেল এদেশের ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিকদের। যাহোক মার্কিনসমর্থিত সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন হয়তো নাজিবুল্লাহর পরিণতি মনে রেখেই। তালেবানের ৫ বছরকাল শাসনের অবসান ঘটল আমেরিকার হস্তক্ষেপে ২০০১ সালে। তারপর একটানা ২০ বছর যুদ্ধ করে আমেরিকা ও তাদের মিত্র সেনাদের হটিয়ে এ বছর ১৫ আগস্ট পুনর্বার কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিলো তালেবানরা। আবার শরণার্থী হতে শুরু করল অসংখ্য মানুষ। দেশ ছেড়ে পালানোর সে দৃশ্য যে কতটা মর্মান্তিক গণমাধ্যমের কল্যাণে তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। তালেবানের আগের শরিয়াহভিত্তিক শাসনে উদারচেতা মানুষ দারুণভাবে নিগৃহীত হয়েছিল। বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা প্রবল বাধার মুখে পড়ে। নারীর স্বাধীনতা ও নারীশিক্ষা বিপন্ন হয়ে উঠে। নারীর ঠিকানা হয় ঘর, বাইরের জগৎ ও বাইরে কাজ করা তার জন্য নিষিদ্ধ হয়। পুরুষের আধিপত্যে নারীর জীবন হয়ে উঠে দাসী-বাদীর। ভিন্নমত উচ্ছন্নে যায়। মধ্যযুগীয় কায়দার শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। প্রগতির চাকা উল্টে যায়। শিল্প সংস্কৃতির আস্বাদন থেকে মানুষ বঞ্চিত থাকে। গোঁড়ামির শাসন কল্যাণ বয়ে আনেনি সার্বিক বিচারে। তালেবানরা জানে সে খবর। এবার তাই বলা শুরু হয়েছে, তাদের এবারকার শাসন আগের মতো হবে না। তবে শরিয়া শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে, পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র থাকবে না, ইসলামি এমিরেট কায়েম হবে। নারীও ঘরের বাইরে বেরোতে পারবে, তবে পুরুষ সঙ্গে নিয়ে। যদি তা-ই হয় তাহলে সে শাসন হবে জোড়াতালির শাসন। সমাজের জন্য সেটি কতটা হিতকর হয় সময় বলে দেবে। তবে সেই জোড়াতালির শাসনও কতোটা সম্ভব হবে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। কট্টরপন্থিরা বাদ সাধতে পারে এতে। সেক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যেও সংঘাতের আশঙ্কা আছে। ২০ বছরে অনেক মানুষ উদারনৈতিক চিন্তায়, উদার আচার-আচরণে, উদার পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে নিশ্চয়ই রক্ষণশীল শাসন তাদের অসন্তুষ্ট করতে পারে। সেই অসন্তোষ নতুন সংঘাতেরও জন্ম দিতে পারে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে অনিশ্চিত। এ যুগে টেকসই শাসনের অপরিহার্য শর্ত গণতন্ত্র, উন্নয়নের জন্যও এটি অতি আবশ্যক। তালেবানের নতুন শাসকগোষ্ঠী একথা মনে না রাখলে ভুল করবে। স্বাধীনচেতা আফগান জনগোষ্ঠীকে বাগে রাখতে গণতন্ত্রের বিকল্প আছে বলে মনে করি না। তালেবানদের এ মুহূর্তে সরকার পরিচালনা বেশ কঠিন হবে বলে বোধ হয়। অর্থনৈতিক সমস্যাই প্রধান হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সহায়তা আপাতত বন্ধ। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যও মিলছে না। দেড় কোটি লোক শিগগিরই খাদ্য সংকটে পড়বে বলে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা আভাস দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও অন্য পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ছে হু হু করে। ডলারের বিনিময়ে আফগানি মুদ্রার মূল্য কমে গেছে। রপ্তানির একটা বড় উৎস ছিল ভারত, তাও বন্ধ হয়ে আছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কমে গেছে। দেশের অর্থ ও সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। খবর বেরিয়েছে- দুবাইয়ের ব্যাংক আমানতে উপচে পড়ছে, সেখানকার আবাসন ব্যবসায় লেগেছে হাওয়া। আমেরিকায় আটকা পড়েছে রিজার্ভসহ বিপুল সম্পদ। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী তালেবানদের আপাতত নির্ভরতা কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, চীন, পাকিস্তানের সহায়তার ওপর। কোথায় কতটুকু কী মিলবে- তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু খরচ অপেক্ষমাণ তাৎক্ষণিক। যোদ্ধাদের এতদিন কমপক্ষে ১৫০ ডলার করে বেতন দেয়া হচ্ছিল, তা অব্যাহত রাখতে হবে। শরণার্থীদের খরচ মেটাতে হবে, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কাজে ব্যয়ের প্রয়োজন হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে। এমনতরো আরো অনেক খরচ জরুরিভিত্তিতে মেটাতে হবে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদের একটা বড় অংশ দেশত্যাগ করেছে বলে শোনা যায়, সেই শূন্যতা পূরণ করতে হবে বিদেশ থেকে জনবল এনে। নারীর প্রতি আচরণ না বদলালে বিভিন্ন পদে আসীন নারীরা কর্মহীন হবে, সেখানেও দেখা দেবে শূন্যতা। সবমিলিয়ে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশাপূর্ণ, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়া তালেবান সরকারের পথচলা বিঘ্নহীন হবে বলে মনে হয় না।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App