×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট উত্তরণে বিশেষ উদ্যোগ জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৪৮ এএম

করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কয়েক ধাপে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘিœত হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাস চালুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এর ফলে শিক্ষার্থীরা কতটা লাভবান হচ্ছে, সেটাই হলো বিবেচনার বিষয়। ইতোমধ্যে অটোপাস ব্যবস্থায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন লাভ করেছে। নতুন ক্লাসে ওঠার পর শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন ক্লাসের বইও পৌঁছে দিয়েছে সরকার। করোনা মহামারির অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমাজের প্রতিটি অংশ। বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে দেশের অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানার উৎপাদন ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্ষতিগ্রস্ত, বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রকারান্তরে দেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে আগামী দিনগুলোতে। করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে রাজধানী ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে অনেক পরিবার। এর বড় একটি প্রতিফলন দেখা গেছে রাজধানীর সাধারণ মানের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। চলতি নতুন বছরের শুরুতে ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেইসব সাধারণ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে অনেক কম সংখ্যায়। এমনিতেই গত বছর করোনার কারণে সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ক্ষতি সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় সামলাতে না পেরে গত বছর অনেক অভিভাবক পুরো পরিবারসহ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। ফলে স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়েদেরও পরিবারের সঙ্গে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে। তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এভাবেই শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। করোনা মহামারির কারণে চলমান সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খাতের জন্য সরকার আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। ফলে পুরোপুরি না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত নানা খাত প্রণোদনা লাভ করে বিদ্যমান বিপর্যয় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতি বছর শুরুতেই স্কুলগুলো নতুন অনেক ছাত্রছাত্রী পেলেও এ বছর প্রত্যাশিত ছাত্রছাত্রী না পাওয়ায় সংকটের মধ্যেই রয়ে গেছে তাদের অস্তিত্ব। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- এটা না মেনে উপায় নেই। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও ঝুঁকি এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার পরিস্থিতি হয়নি। তেমন অবস্থায় সংকটজনক অবস্থায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে আরো। করোনাকালের সংকটের মধ্যেও বেসরকারি চাকরিজীবীরা কমবেশি বেতন-বোনাস পাচ্ছেন। নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে আর্থিক প্রণোদনাও পেয়েছেন। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীদের খবর কেউ রাখেনি। দেশের প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী দেড় বছর ধরে বেতন-বোনাস পাচ্ছেন না। অনেকে পেশা বদল করেও টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছেন। চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। দেশে প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। টিউশন ফির টাকায় এসব স্কুলের বাড়ি ভাড়া, নানা ধরনের বিল ও শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়। এসব স্কুলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ালেখা করে সাধারণত। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা আর টিউশন ফি দিচ্ছেন না। ফলে গত বছর মার্চ থেকে ১৬ মাস ধরে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের বেতন-বোনাস বন্ধ রয়েছে। এমনিতেই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা স্কুল থেকে খুব কম বেতন পেতেন। তারা প্রাইভেট টিউশনি করে বেতনের কয়েকগুণ টাকা আয় করতেন। করোনাকালে প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ থাকায় তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছেন। এখন এই শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ কেউ সবজি, ফলমূল বিক্রি করছেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, কেউ দোকানে কর্মচারীর কাজ নিয়েছেন। বেশিরভাগ এরই মধ্যে তাদের পরিবার-পরিজন গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অনেক পরিবার এখনো আর্থিক দুরবস্থার কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। তাদের শহরে পরিবার-পরিজনসহ ফিরে আসার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি কবে সৃষ্টি হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া পরিবারগুলোর সন্তানদের স্কুল থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়াটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত কিংবা কাম্য না হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাই ঘটছে, করোনার কারণে দেশের অনেক শিক্ষার্থীই স্কুল থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে নিয়মিত অনিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। তবে এর বাইরে দেশের বড় একটি অংশের শিক্ষার্থী আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে, যাদের বেশিরভাগেরই বসবাস গ্রামে। এটা এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে বটে। এটা সবাইকে মানতে হবে, করোনা সংক্রমণের প্রভাবে গোটা বিশ্বে সব খাতে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। আমাদের দেশে এটা ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাধারণভাবে মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি বন্ধ হয়েছে বা উপার্জনের পরিমাণ সংকুচিত হয়েছে। কাজ হারিয়েছেন প্রচুরসংখ্যক মানুষ, যার ফলে শহর ছেড়ে অনেক পরিবার গ্রামে ফিরে গেছে। এটি এক ধরনের বাস্তুচ্যুতি। এই বাস্তুচ্যুতি সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়, বন্যা, নদীভাঙনের কারণেই হয় বেশিরভাগ। সেটি এবার ভিন্ন রূপে ঘটেছে আমাদের দেশে মহামারিতে। এ কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারের শিশুরা আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারছে না। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে মারাত্মকভাবে। তবে শিশুরা শহরে থাকুক কিংবা গ্রামে থাকুক, তারা তো এ দেশেই রয়েছে। সুতরাং স্কুল থেকে এসব শিক্ষার্থী শিশুদের ঝরে পড়ার ব্যাপারটি আমাদের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে আগামী দিনগুলোতে। দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। আমরা এগিয়ে চলেছি অগ্রগতি সমৃদ্ধির নতুন সোপানের দিকে, যেখানে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছে এবং প্রশংসা করছে বাংলাদেশের বর্তমান বিচক্ষণ, শক্তিশালী নেতৃত্বের। সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন নেতিবাচক প্রভাব কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার অনেক কমেছে। দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অধিকতর উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক দেশেই দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত, আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনসংখ্যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারির আকস্মিক বিপর্যয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে আসা অপ্রত্যাশিত সংকট উত্তরণে সবাইকে আলাদাভাবে সক্রিয় ও সচেতন হতে হবে। করোনার অভিঘাতে বেসামাল পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App