×

মুক্তচিন্তা

জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি : অসহায় মানুষ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:৪৮ এএম

বাংলাদেশের রাজনীতি এক জনবিচ্ছিন্ন যুগ অতিক্রম করছে। আপাতদৃষ্টিতে তা চোখে পড়ে না। কারণ কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ যখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয় তখন দেখা যায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি। করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত বাংলাদেশের বিশাল বিশাল মাঠ-ময়দানগুলো। টিভি চ্যানেলগুলোতে এই প্রচারণা যেভাবে দেখানো হয় সংবাদপত্রগুলোতে তেমন নয়। সেখানে সমাবেশের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হলেও সচরাচর তার ছবি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রকাশিত থাকে। তবে সন্দেহ নেই, জমায়েত বা সমাবেশগুলো হয় আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি, বাংলাদেশের রাজনীতি এক জনবিচ্ছিন্ন যুগ পার করছে আবার পরক্ষণেই বলছি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশ হয় বিশাল। পরস্পর বিরোধী বক্তব্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যই প্রকৃত সত্য। এই সত্যের পেছনে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে- তা এখন উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে ওই সমাবেশগুলোতে যারা হাজারে হাজারে এসে জমায়েত হয়েছেন তারা কি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ থেকে এসেছেন? খোঁজ নিলে দেখা যাবে স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ থেকে আদৌ নয়- তারা এসেছেন নিজ নিজ জেলা, উপজেলা এবং শহরের ওয়ার্ডগুলোর প্রতাপশালী নেতাদের চাপে এবং ওই নেতাদের আয়োজিত পরিবহনে চড়ে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ওই মানুষদের জন্য স্থানীয় নেতারা বকশিশ হিসেবে টাকাও দিয়ে থাকেন- হাজার হাজার প্যাকেট খাবারও দিয়ে থাকেন। এভাবে বিশাল বিশাল সমাবেশ ঘটানো শুরু হয় জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। তিনি রাজনীতি করার লক্ষ্যে মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয়ার উদ্দেশ্যে খাল কাটা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কৌশলী পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। শেষমেশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালেই দেশের নানা চেনা-অচেনা মুখকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ অবলম্বনে প্রভাবিত করে তাদের নিয়েই তার দলটি গঠন করেছিলেন কোনো আদর্শে নয়- ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা এবং দলে আনীত লোকজনদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা। যারা ওই দলে ছিলেন, তারাও কোনো আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়- মূলত আয় গোছানোর লক্ষ্যেই সামরিক কর্মকর্তার ডাকে রাজনীতিতে আসেন। এর ব্যতিক্রমী ছিলেন তার দলে অত্যন্ত অল্পসংখ্যক। তারা ছিলেন শুরু থেকেই কোণঠাসা। আমাদের মনে থাকার কথা, জিয়াউর রহমানের এই দলে যোগ দেয় জাসদপন্থিদের একটি বড় অংশ, রংপুরের ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ভাসানী ন্যাপের প্রায় সবাই, মুসলিম লীগ ও জামায়াতপন্থি অনেকেই (যারা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধিতাও করেছিলেন)। অপরপক্ষে দেশের বুকে নেমে আসা কঠোর সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর তাদেরই আনীত স্বাধীনতা-স্বাধীন দেশে দফায় দফায় কারারুদ্ধ ও অন্যবিধ নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আত্মরক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশে অবস্থান নেয়ায় জিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দল জাসদ অবশ্য পরে ওই দল থেকে বেরিয়ে আসে। তবে বহুদিন ওই সত্তর ও আশির দশকে তাদের ‘কমরেড জিয়া-লাল সালাম’, ‘রুশ-ভারতের দালালরা হুঁশিয়ার সাবধান’ জাতীয় সেøাগান দিতে দেখা গেছে সারাদেশেই। জিয়া একটি বাক্য বলেছিলেন, ‘রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে আমি অসাধ্য করে তুলব’- রাজনীতির মাঠ পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই দেখা যাবে, এই বাক্যটি আজো রীতিমতো বহাল রয়েছে দফায় দফায় শাসকগোষ্ঠীর অঙ্গন বদল সত্ত্বেও। এবারে আসা যাক যারা ওই সব সমাবেশে লোক আনা-নেয়ার জন্য গাড়ি-ঘোড়া ভাড়া করেছেন, খাবার প্যাকেট সরবরাহ করেছেন তারা ওই টাকা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন সেই প্রশ্নে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে সিংহভাগ ব্যয় নির্বাহ করেন আর বাদ বাকিটা নিজেদের পকেট থেকেও দিয়ে থাকেন। ফলে বেশি বেশি লোক যারা টানতে পারেন তাদের দলে উচ্চ পদ এবং কন্ট্রাক্টরিসহ নানাভাবে আয়-উপার্জন বৃদ্ধির ব্যবস্থাও করা হয়। এভাবে মানুষ জমা করে দেয়াটাও একটা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে। বিগত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে বড় ধরনের সভা-সমাবেশের আয়োজন না থাকায় ওই ব্যবসায় সাময়িকভাবে ভাটা পড়লেও আগামী ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকে তা নতুন করে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য যদি বর্তমানের মতো করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে এবং পরিস্থিতিটা পুরোপুরি যদি নাও হয়, মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। রাজনীতির অঙ্গনে ব্যবসায়ীদের দাপটে বিচরণ জিয়ার আমলে শুরু হলেও এরশাদ, খালেদা জিয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর আমলেও তা দিব্যি বহাল থাকে। এদের দাপট ক্রমেই বেড়ে উঠছে আজো। সংসদ সদস্যদের পেশাগত অবস্থান, বহুসংখ্যক মন্ত্রীর পেশাগত অবস্থানের দিকে তাকালেই এ বক্তব্যের যথার্থ খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তান আমলে তো দীর্ঘ ২৩ বছরের মধ্যে মাত্র দুবার সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। তবুও তৎকালীন সংসদগুলোর চিত্রও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তৎকালীন সংসদগুলোয় ব্যবসায়ীদের অবস্থান ছিল না তা নয়; কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম- শতকরা হিসাবে ৫ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু আজ তা বেড়ে শতকরা ৭০-এর কাছে পৌঁছেছে। ফলে আমাদের মহান সংসদে ব্যবসায়ীরা প্রধান প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবসায়ীরা কিন্তু রাজনীতি করেন না রাজনৈতিক অর্থে। যেটুকুও বা করেন তা মূলত ব্যবসায়ী স্বার্থে। তেমনি যারা নিজ নিজ ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজনীতি করেন- তারা নানা ক্ষেত্রে অবাধে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। কন্ট্রাক্টরিতে তাদের দাপট অপরিসীম। স্বাস্থ্য খাতে, সড়ক ও জনপথ খাতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমের সঙ্গে তারা দাপটে দিব্যি নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছেন। এর প্রত্যক্ষ ছাপ বাজারে হরহামেশা পড়ে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি করোনা যুগে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কি হাসপাতাল নির্মাণ, কি রোগীদের ওষুধ পথ্য কেনা-বেচা, করোনার টেস্ট রিপোর্ট প্রদান ও টেস্টের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই দুর্নীতি প্রসারিত। স্বাস্থ্যের অপরাপর ক্ষেত্রেও অনুরূপ চিত্র বিরাজ করছে। সড়ক, জনপথ, সেতু নির্মাণে অসংখ্যবার সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে এগুলোর নির্মাণে পৃথিবীর অপরাপর দেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি খরচ পড়ে বাংলাদেশে। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নানা সূত্রে পাওয়া এই খবর বারংবার প্রচারিত হলেও পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয় না। তেমনই পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার সিন্ডিকেট, চালের মিল মালিকদের সিন্ডিকেট, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিনসহ অন্যান্য তেল- এসব নানা ক্ষেত্রেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এগুলোর পরিণতি হলো দুর্নীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাস্তাঘাট, সেতু প্রভৃতি নির্মাণের অব্যবহিত পরেই বা নির্মাণকালেই ধসে পড়া, রাস্তার পিচের আস্তর দ্রুত উঠে যাওয়া, নদী উদ্ধার ও ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের দাপট ভয়ানকভাবে বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দুদক নামে সংস্থাটির অস্তিত্ব পত্র-পত্রিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, জনগণ তাদের কাজকর্ম আদৌ চোখে দেখতে পায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে ইচ্ছাকৃভাবে ঋণখেলাপি হয়ে নানা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের বা তার সুদের ক্ষুদ্র অংশ পরিশোধ করে ঋণ শোধের মেয়াদ বাড়ানো এবং অতঃপর নির্বাচন এলেই বড় কোনো দলে যোগ দিয়ে এমপি বনে যাওয়া এবং তারপর আবার নতুন নতুন ঋণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে পুরনো ঋণ শোধ না করেই নতুন ঋণ নেয়া এবং বিদেশে পাচার করা, বিদেশে বাড়ি ও ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণ প্রভৃতি করে দিব্যি সংসদ সদস্যের পদে বহাল থাকা ইত্যাদি। অবাধে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে ফেরত আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগও কদাপি চোখে পড়ে না- ওই দুর্নীতির কারণেই। দায়ী ব্যক্তিরাও নিরাপদে সাধুবেশে ঘুরে বেড়ান। এসবে জড়িত প্রধানত সরকারি দল হলেও বড় বিরোধী দলও তা থেকে আদৌ ভিন্ন চরিত্রের নয়। তারাও ওই ধরনের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত এবং সে কারণেই দুর্নীতি দমনের দাবিতে কদাপি তাদের রাস্তায় নামতে, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন প্রভৃতি করতে দেখা যায় না। এমনকি উভয় দলের একটি অংশ যৌথভাবে এই দুর্নীতিপ্রবণ ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত এমন দৃশ্যও বিরল নয়। দুদক কোনো কাজই করে না আমি এমন অভিযোগ করছি না। কাজ করে তবে ক্ষমতাসীন দলকে স্পর্শ না করে। দল বিশেষের ব্যাপার নয় এটা। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে দুদক তার স্বার্থেই সংরক্ষণ করে। বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধেই প্রধানত মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করাই তাদের রীতি। জনগণ এই পরিস্থিতির, রাজনীতির এই কদর্য চেহারার অসহায় দর্শক মাত্র এই তা জিয়ার আমল থেকে আজ পর্যন্ত বহাল থাকায় মানুষ আর রাজনীতিতে কোনো সৎ লোক আছেন বলে বিশ্বাস করতে চান না। ফলে নীরবে তারা রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান নিয়েছেন। এটাও একটা কারণ- বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাষণের জন্য আয়োজিত সমাবেশগুলোতে যেমন লাখে লাখে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পায়ে হেঁটে যোগ দিতেন আজ আর তারা তা করেন না। তাই গাড়ি করে, খরচা ও খাবার দিয়ে তাদের নিয়ে গিয়ে সমাবেশকে বড় করতে হয়। একই অবস্থা জেলা পর্যায়ের নেতাদের সভাতেও দেখা যায়। এই অবস্থা যতদিন রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজ করবে, রাজনীতির প্রতি জনগণের অনীহাও ততদিনই বিরাজ করবে। আর এর পরিণতিতে রাজনীতিতে মানুষ যোগ না দেয়ায় সততাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ছোট ছোট নীতিনিষ্ঠ দলগুলো এবং মূল অর্থে জনগণই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশে। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক E-mail : [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App