×

মুক্তচিন্তা

শোকের মাসে আমরা বঙ্গবন্ধুকে কতটা স্মরণ করলাম?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৬ এএম

আগস্ট মাস পার করে আজ আমরা সেপ্টেম্বরে ঢুকে পড়েছি। আমরা সবাই জানি, আগস্ট মাস বাঙালির শোকের মাস। জাতির পিতাকে হারানোর শোক। তাই জাতি অত্যন্ত বেদনাক্রান্ত মনে নানান আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় জাতির পিতা হারানোর শোক পালন করবে- এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু এ শোক পালন করার ধরন, মাত্রা এবং দর্শন কেবলই একজন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর শোক নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ইতিহাসের এক জঘন্যতম এবং নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাই জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে বা মৃত্যুর মাসে পিতাকে স্মরণ করে কেবলই ভারাক্রান্ত মনে বেদনাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রæ বিসর্জন করার মধ্যেই জাতির কাজ সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কেবলই একজন রাষ্ট্রপতিকে বা একজন দলীয় নেতা হত্যা নয়; বরঞ্চ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শকে হত্যা করার সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে কবর দেয়ার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তাই প্রতি বছর আগস্ট মাসে আমরা জাতীয় শোক দিবস পালন করি, কিন্তু সেটা কী কেবলই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাকি বঙ্গবন্ধুর গৌরবময় জীবন, রাজনৈতিক আদর্শ এবং গণমুখী রাজনৈতিক দর্শনকে আমরা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি, সেটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। তাই আগস্ট মাস শেষ হওয়ার পর আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদেরই প্রশ্ন করতে হবে : শোকের মাসে আমরা বঙ্গবন্ধুকে কতটা স্মরণ করলাম? আমাদের জন্য এটা জানা খুবই জরুরি যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শনকে সমাজের অভ্যন্তরে, সমাজের বিদ্যমান ব্যবস্থায় এবং সমাজের সক্রিয় চলমানতায় কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি, কতটা প্রয়োগ করতে পেরেছি এবং কতটা সঞ্চারিত করতে পেরেছি। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছি, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সামরিক শাসন ছিল ১৫ বছর। সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক ছিল ২ বছর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ছিল ১০ বছর। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরের বলয়ের শাসকরা এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ বছর। এ ২৭ বছর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং অবদানকে মুছে ফেলার নানান ষড়যন্ত্র হয়েছে। ইতিহাসের বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে নানান কৌশলে। স্বাধীনতার ঘোষণাকে বিতর্কিত করে বেহুদা ফায়দা নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেয়া হয়েছিল এদেশে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের নেতাদের গাড়িতে তোলে দেয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।’ সুতরাং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ৫০ বছর একেবারেই স্বাভাবিক, নিয়মতান্ত্রিক এবং সমান্তরালে যায়নি। নানান কণ্টকাকীর্ণ পথে, নানান চড়াই-উতরাই পার হয়ে এবং নানান উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি। একটা সময় ছিল রাজাকার কথাটা মুখে উচ্চারণ করা যেত না। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ তার একটি নাটকে তোতা পাখি দিয়ে বলিয়েছিলেন ‘তুই রাজাকার’। কিন্তু সব ধরনের বাধা পেরিয়ে আজ যখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তখন শোকের মাস আগস্ট যেন কোনোভাবেই কেবলই বেদনাক্রান্ত মনে পিতার জন্য অশ্রæ বিসর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। জাতির দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় জাতির পিতার জীবন, আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একাগ্র হয়ে একত্রে কাজ করা। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল এদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য। নানান অত্যাচার, মামলা-মোকাদ্দমা, জেল-জুলুম বঙ্গবন্ধু হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে প্রায় ৪ হাজার ৬৮২ দিন বা প্রায় ১৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন কার জন্য? এদেশের মানুষের জন্য। এদেশের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য। এদেশের মানুষের জন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে এদেশের মানুষের যে অপরিশোধ্য ঋণ সেটা পরিশোধের পরিবর্তে নিমক হারামির মতো কিছু বেইমান বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করেছে। যারা হত্যা করেছে, তারা তো এদেশেরই লোক। এদেশেরই আলো-বাতাসে বড় হওয়া লোক। তাই আগস্টের শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর জন্য, জাতির পিতার জন্য শোক পালনের পাশাপাশি ইতিহাসের এ নির্মম সত্যকেও সামনে আনা জরুরি। নতুন প্রজন্মের মনে, মননে, মানসে এবং চিন্তা-চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শন আমরা কতটা সঞ্চারিত করতে পেরেছি, তার মধ্যেই নিহিত আছে শোকের মাস পালনের যথাযথ মাহাত্ম্য। কেননা আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে যেন আসল কাজটি ঢাকা পড়ে না যায়, সেটা মনে রাখা জরুরি। আমি পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম, “আজকের প্রজন্মকে জানতে হবে আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু আছেন।… তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর জীবনাচার, তাঁর রাজনীতির মূল প্রেরণা এবং শক্তি দেশের মানুষের ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর তীব্র ভালোবাসা।… দেশের মানুষের প্রতি এ তীব্র ভালোবাসাই শেখ মুজিবুর রহমানকে সত্যিকার বঙ্গবন্ধুতে পরিণত করেছিল। একটি দেশের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বনেতা। মানুষের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যান্য অনেক নেতার কাতারে উজ্জ্বল তারকা হয়ে শোভা পাচ্ছে আমাদের বঙ্গবন্ধু। আমাদের ভালোবাসার, আমাদের গর্বের, আমাদের প্রাণের এবং আমাদের প্রেরণার বঙ্গবন্ধু। নতুন প্রজন্মকে এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। জানতে হবে এদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস এবং সে ইতিহাস নির্মাণের প্রধান চরিত্রকে। জানতে হবে একজন মানুষের সত্যিকার ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠবার ইতিহাস।” এ জানানোর কাজটা আমরা কতটা করেছি শোকের মাসে, তার ওপরই নির্ভর করবে আমরা জাতির পিতাকে যথাযথভাবে স্মরণ করতে পেরেছি কিনা। পরিশেষে বলব, বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য, মহানত্ব, বিশালত্ব এবং সুমহান ব্যক্তিত্বের কারণেই নানান ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে এদেশের মাটি থেকে মুছে ফেলা যায়নি। বঙ্গবন্ধু এদেশের মাটি-মানুষের নেতা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা ছিলেন, তাই গণমানুষই বঙ্গবন্ধুকে জিইয়ে রেখেছে এদেশের আমজনতার চেতনায় এবং দেশপ্রেমের আদর্শে। প্রতি বছর আগস্ট আসে, আমরা জাতির পিতার মৃত্যুতে শোক পালন করি, কিন্তু পিতার যোগ্য জাতি হিসেবে পিতার আদর্শ ও দর্শনকেও যেন আমাদের জীবনাচারে, আমাদের কার্যকলাপে, আমাদের দেশপ্রেমে, মানুষের প্রতি ভালোবাসায় এবং সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি করণীয় নির্ধারণে যথাযথভাবে লালন ও পালন করি। বঙ্গবন্ধুই বলেছিলেন, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতে পারে।’ সুতরাং মানুষকে ভালোবাসার দর্শনকে আমাদের জীবনাচারে ধারণ করতে হবে, তবেই মানুষের ভালোবাসার ফেরত পাওয়া যাবে। শোকের মাসে আমরা কতটা শোক পালন করেছি আর কত শোকের আবেগকে শক্তিতে পরিণত করে পিতার আদর্শকে আমরা আমাদের ব্যক্তি-জীবন, সমাজ-জীবন ও জাতীয়-জীবনে কতটা চর্চা করছি, সেটাই নির্ধারণ করবে ‘শোকের মাসে আমরা বঙ্গবন্ধুকে কতটা স্মরণ করলাম?’ ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App