×

মুক্তচিন্তা

ক্ষমতায় তালেবান, উত্তপ্ত আমেরিকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৭ এএম

এককালের আফগান মুজাহিদীন ওরফে ইসলামিক গেরিলা ফাইটার ওরফে দুর্র্ধর্ষ তালেবান সৌদি আরব, পাকিস্তান আর সিআইএর (Central Intelligence Agency) সম্মিলিত চাষাবাষের দুর্দান্ত ফসল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বিবেকহীন মানবাস্ত্র তারা। এরাই আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর স্বপ্নরাজ্য ‘Democratic Republic of Afghanistan’-এর সমাধি রচনা করেছিল তার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। কিন্তু তাতে তালেবানদের কর্তব্য শেষ হয়নি। দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ’৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করে তারা দেশকে ‘Islamic Emirate of Afghanistan’ বানিয়ে নিজস্ব ফ্লাগ উড়িয়ে দেয়। আমেরিকার চোখে তখন রাশিয়াকে টুকরো করার অন্ধ আনন্দটাই কেবল উচ্ছল হয়ে ঝরছে। তালেবান সৃষ্টির পরিণতি কোন ভয়ংকর ভবিষ্যতের জন্ম দিতে চলেছে, সেটা বিশ্লেষণের মানসিকতা সুপার পাওয়ারের ছিল না। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির বুদ্ধিমানরা ৩০ বছর পরও জেহাদি তত্ত্ব কতটা বুঝতে শিখেছেন, তাদের কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে নিরূপণ করা কঠিন। এরা অন্তহীন মহাকাশের নাড়িনক্ষত্রের সংবাদ ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, গণিতশাস্ত্রের হিসাব কষে নিচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত জিহাদি জগতের সুগভীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে তাদের বারবারই ভুল হয়। যাই হোক, ২০২১-এর আগস্ট মাসে নব্বই দশকের মতোই উত্তাল হচ্ছিল আফগানিস্তান। তার দুঃসহ অস্থিরতা অধৈর্যে উত্তাল করছিল আমেরিকাকে। এমনিতেই আমেরিকা উত্তপ্ত গত বছর থেকে। সংক্ষুব্ধতা সবার অন্তরজুড়ে। কারণ বাইডেন প্রশাসনের নতুন পলিসিতে ক্রাইম প্রায় আকাশচুম্বী। উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে সহস্র সহস্র নামপরিচয়হীন মাইগ্র্যান্টরা জলস্রোতের মতো প্রবেশ করছে হররোজ। তাদের টি-শার্টে বুকের ওপরে লেখা ‘Biden Please Let us in!’ নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ওপেকের ওপর (Organization of the Petroleum Exporting Countries) দেশকে পুরোপুরি নির্ভরশীল করেছেন প্রেসিডেন্ট। সঙ্গত কারণেই গত বছরের তুলনায় জ্বালানির মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তারপরও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি অর্থহীন বিচিত্র প্রজেক্ট খাড়া করে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢালছেন জনগণের ট্যাক্স বাড়িয়ে। ওদিকে বেকার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও লেবার শর্টেজ চলছেই। অন্যের ট্যাক্সে বসে খাওয়ার অনুমোদন পেলে কে আর পরিশ্রম করে? এরপর প্রেসিডেন্টের অনভিজ্ঞতায় তালেবানদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের যখন হাঁড়ির হাল, তার দশা দেখে পাকিস্তান, তালেবান আর আলকায়েদা মিলে বিজয় উৎসব করছে তখন সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মজুড়ে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভও বিকশিত হচ্ছে শতধারায়। দুয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে আনা যাক ক্ষুব্ধ জনতার মন্তব্য হিসেবে- Biden must address the World from his own head and not a tele prompter with the words from some other source. Biden must take and answer all questions and not ‘cut and run’ after his address to the World জনতার ক্রোধের কারণ, এমন দুঃসহ মুহূর্তেও আফগানিস্তানের বিষয়ে সত্যিকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুধু পিঠ দেখিয়ে পোডিয়াম ছেড়ে প্রেসিডেন্টের বারবার চলে যাওয়া। সমালোচকরা বলেন, বাইডেন কখনো নিজের কথা সংবাদ সম্মেলনে বলেন না। অন্যের সাজানো কথা পড়ে যান মাত্র। সবার প্রশ্ন তিনি গ্রহণও করেন না। প্রেসিডেন্টের কথায়- I was instructed to take question from certain reporters! যুক্তরাষ্ট্রের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার কল্যাণে এখনো অবধি প্রেসিডেন্টকে সত্যিকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়নি। তিনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ইউ এস টুডে, দ্য হিল, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, সিবিএস, এমএসএনবিসি ইত্যাদি সংবাদমাধ্যমের ইনকিউবেটরে ঢেকে রাখা সযতেœ লালিত সাজানো প্রেসিডেন্ট। বাইডেন নিজেও বলেছেন- I am not supposed to be answering all these questions. If I answer this question, I will be in trouble. এখন অবশ্য দু-চারটি কঠিন সমালোচনা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সৈন্যসামন্তরাও করছেন। কারণ তার প্রেসিডেন্সি আমেরিকার ইন্টারন্যাল রাজনীতিতে যে বিশৃঙ্খলার ঝড় তুলেছিল তাকে বিশ্বের কাছে আড়াল করা গেলেও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের নির্বোধ কৌশলে ফরেন নীতির যে দুবর্লতা প্রকাশিত, তা জুগৎজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। ‘বাগরাম এয়ারপোর্ট’ থেকে আগেই মার্কিন ইন্টেলিজেন্স আর সামরিক বাহিনী সরিয়ে নিয়ে তালেবানদের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেয়া কত বড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল, কোনো ব্যাখ্যা দিয়েই করপোরেট আমেরিকার সাংবাদিকদের পক্ষে সেটা ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আত্মঘাতী বোমারু দিয়ে এতগুলো প্রাণবিয়োগের ট্র্যাজিক ঘটনায়, কোয়ালিশনে কাজ করা অন্যান্য রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছুমাত্র অবহিত না করায়, তাদের প্রস্তাব কানে না তোলায় প্রেসিডেন্ট বিরাগভাজন হয়েছেন সুহৃদদের কাছেও। সেদিন জুন মাসের G-7 সামিটে যাদের কাছে গদগদ হয়ে তিনি বলেছিলেন ‘U.S is back!’ তারাও হতাশ আর বিস্মিত। কারুর কারুর মতে- This is the first time Biden is under water! কিন্তু কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে এত বড় ব্যর্থতার দায়ভার শুধু কি প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেনের? তার মতামতকে হোয়াইট হাউস কি সত্যিই বিবেচনা করে? তাহলে ব্যর্থতা কার? ইন্টেলিজেন্স সেক্টরের? মিলিটারি লিডারদের? প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণের? নাকি হোয়াইট হাউসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের? কেউই এর দায় নিতে অবশ্য রাজি নন। তাদের মতে, এই ব্যর্থতা প্রেসিডেন্ট ঘানির এবং আফগান সৈন্যদের। কারণ They had all the advantages, they had 20 years of training by our coalition forces, a modern air force, good equipment and weapons, but you can’t buy will and you can’t purchase leadership! তালেবানরা কাবুলে প্রবেশের আগেই ঘানি প্রাসাদ ছেড়ে, প্রজাসাধারণকে পেছনে ফেলে কোটি কোটি মার্কিন ডলার নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। মাস্তুলহীন নৌকার কাণ্ডারি হয়ে লড়াই করতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সও অনিচ্ছুক। তবে এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মার্কিন জনতার মতামত খুব পরিষ্কার। তারা বলছেন- যে দেশে প্রেসমিডিয়া, বিগ বিজনেসম্যান, এফবিআই আর সিআইএসহ পেন্টাগনের কমান্ডার, জেনারেলরা পলিটিসাইজড হয়ে যান এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং তার ভোটারদেরই একমাত্র শত্রæ বিবেচনা করে মেধা, বুদ্ধি, কূটনীতি, শক্তি শানিয়ে চলেন, সেখানে এমনটাই হয়! সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র ভুল করলেও ব্যাকোয়ার্ড তালেবানেরা কিন্তু ভুল করেনি ছকে ছকে পা রেখে পদক্ষেপ ফেলতে। তারা বুঝেছিল, আমেরিকার দুর্বল নেতৃত্ব ত্রæটিপূর্ণ ডিপ্লোম্যাসিতে স্বদেশে এবং ফরেন কান্ট্রিতে যে ভুলের পাহাড় জমাচ্ছে, তার আড়ালে দাঁড়িয়েই তাদের জিহাদি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এবং এখনই তার মোক্ষম সুযোগ। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলে, স্কুল, কলেজ, বিমানবন্দর নির্মাণ করে, আফগানদের অত্যাধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে ট্রেনিং দিয়ে এবং মাসমাইনে স্যালারি বিলিয়ে কেন আফগানিস্তানকে সভ্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা গেল না, তার জবাব খোঁজার তাগিদ এখনো এদেশের প্রশাসনের নেই। ২০ বছর পরে আরো বেশি শক্তি সঞ্চয় করে কেন তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, তার গভীর তত্ত্বেও এরা প্রবেশ করতে চান না। অনেকে মানতেই চান না, আরব বিশ্বে কোনো জিহাদি গ্রুপই আগাছা নয়। তারা সব বিরাট বিরাট মহিরুহতে আশ্রয় পাওয়া পরগাছা। এবং আরবের মাটিতে তো বটেই, বিশ্বজুড়েই তাদের সরবে কিংবা নীরবে সমর্থন দিতে কোটি কোটি উৎসাহী মানুষের অভাব নেই। আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকার এই চরম দুর্দশার কথা কিছুদিন বাদেই হয়তো মিলিয়ে যাবে কোটি মানুষের স্মৃতির পাতা থেকে। কিন্তু সেই বাস্তবতা ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে, যা এখনো ভ্রƒণের অবস্থায় মানুষের স্থূল চর্মচক্ষুর অন্তরালে ঢাকা পড়ে থাকলেও তার অস্তিত্বকে একদিন আর আড়াল করা যাবে না। বাইডেনের পলিসিতে যে লাখ লাখ অবৈধ মাইগ্র্যান্টের সীমান্ত অতিক্রম করার সবুজ সংকেত দেয়া হচ্ছে, তাদের ভেতর আইসিস, আলকায়েদা, তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়বা কিংবা বোকোহারাম সংগঠনের অনুসারী নেই, কে তার নিশ্চয়তা দিতে পারে? কে নিশ্চয়তা দিতে পারে নিকট ভবিষ্যতে এই উদার মানবিকতার বিশাল শক্তিশালী দেশজুড়ে তাদের পদধ্বনি দাপিয়ে বেড়াবে না? সেদিন আমেরিকাকে অহর্নিশি উত্তপ্ত হয়েই থাকতে হবে কিনা? লাখ লাখ বছর আগে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শক্তিশালী বিশালদেহী ডাইনোসরদেরও তো পড়তে হয়েছিল! দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App