×

মুক্তচিন্তা

নিকট-অতীতের ঐতিহাসিক সত্য উদ্ধার করা সম্ভব

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২১, ০১:০৪ এএম

সুদূর অতীতের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা একসময় প্রায় অসম্ভবই ছিল। কিন্তু মানুষ সবকিছুই জানার কৌতূহল নিবারণ করতে বছরের পর বছর তথ্য অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি পরিচালনার মাধ্যমে সুদূর অতীতের অনেক কিছুই উদ্ধার করতে পেরেছে। হয়তো সব কিছু এখনো করা সম্ভব হয়নি। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে লাখ লাখ বছর আগের ইতিহাসের বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে। সেই তুলনায় নিকট ইতিহাসের সত্য উদঘাটন করা অনেক বেশি সহজসাধ্য কাজ। ইতিহাসবেত্তা, গবেষক ও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিরা মানব ইতিহাসের সব কালের তথ্য উদঘাটন, উপাদান, উপকরণ সংগ্রহ করে গত প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায়, অঞ্চল এবং পূর্ববর্তী ও সমকালীন মানুষের ইতিহাস রচনা করে আসছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখনো অনেক তথ্য-উপাত্ত, উপকরণ বিভিন্ন স্থানে উদ্ধার করা হচ্ছে, যার ভিত্তিতে অতীতের অনেক ধারণা এবং জানা বিষয় এখন কখনো কখনো ভুল প্রমাণিত হচ্ছে, আবার নতুনভাবে জানার পরিধিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রায়ই আমরা এ ধরনের অনেক ঐতিহাসিক তথ্য, উপাদান উপকরণ, আবিষ্কারের কথা প্রচারিত হতে দেখি, অনেকে তাতে বিস্মিত হয়, আবার অনেকে নতুন প্রাপ্ত তথ্যে উজ্জীবিত হয়। এটি সাধারণত ঘটে অতীতের কম জানা না জানা ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে কোনো কিছু আবিষ্কৃত হওয়ার খবর শোনা গেলে। একেবারে সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের ঘটনা জানার জন্য আমাদের মোটেও উদ্বিগ্ন হতে হয় না কিংবা হতাশ হতে হয় না। নিকট-অতীতের সংঘটিত কোনো গুরত্বপূর্ণ ঘটনার নানা লিখিত তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করলেই পাওয়া সম্ভব। যদি ঘটনাটি হয় রাষ্ট্রের কোনো গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা স্থানকে কেন্দ্র করে তাহলে তো কথাই নেই। এর ওপর যদি ব্যক্তিটি হন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের মতো গুরুত্ব বহনকারী তাহলে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি সেটি জানার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলেই ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা সম্ভব। আধুনিক দুনিয়ায় এমন গ্রহণযোগ্য উপায় থাকার পরও আমাদের দেশে নিকট-অতীত ইতিহাসের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমরা নানা ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখছি, যা মোটেও কাম্য নয়। একসময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে দেয়া হয়নি। সেটি ছিল এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কিংবা সুবিধাভোগকারী, যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা রাষ্ট্রীয়ভাবেও করেছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘাতকদের বিচারের আয়োজন করেছিলেন। বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর বেশ কিছু ঘাতকের নাম আদালতে প্রমাণিত হয়। তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং আদালতে রায় কার্যকর করা হয়। অবশ্য ঘাতকদের কয়েকজন বিদেশে পালিয়ে আছে। তবে এই বিচারই ১৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনাবলির ইতিহাস জানার জন্য যথেষ্ট নয়। সামগ্রিক ঘটনাবলির সত্যাবলি জানার জন্য উচ্চতর অনুসন্ধান কমিশনের মাধ্যমে নেপথ্যের সবকিছু সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন। সেই দাবি অনেক আগেই উঠেছে, সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে যে অচিরেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সমগ্র রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতা আরোহণে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, ক্ষমতার ৫ বছর কালে বিভিন্ন অভ্যুত্থান, দমন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে চট্টগ্রামের সেনা অভ্যুত্থানে তার নিহত হওয়া, ওই হত্যাকাণ্ডে কারা অংশ নিয়েছিল, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তখন যাদের হত্যা করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমানের মরদেহ কোথায়, কীভাবে, কারা কবরস্থ করেছিল এবং ঢাকায় চন্দ্রিমা উদ্যানে তার লাশ সমাহিত করা নিয়ে নানা প্রশ্ন তখন থেকেই চলে আসছে বিএনপি জিয়াউর রহমানের হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার পরও। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে এক মেয়াদকালে বিএনপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের হত্যা সম্পর্কে সরকার কিংবা তার পরিবার কোনো মামলা করেনি। কিংবা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও নাম জানাতে উদ্যোগ নেয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে অতীতেও অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে দেখা গেছে। কিন্তু এমন একটি দুঃখজনক ঘটনার প্রকৃত তথ্য ও সত্য জাতি এবং রাষ্ট্রের কাছে জানা থাকা দরকার। তাহলে কোনো বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ কেউ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী একটি আলোচনা সভায় চন্দ্রিমা উদ্যানের সমাহিত লাশটি জিয়াউর রহমানের নয় এমন বক্তব্যের সঙ্গে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেছেন যেগুলো ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে নিরূপিত হওয়া দরকার। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘হাস্যকর’ বলে দাবি করা হয়েছে। তাতেই দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে রাজনীতির নানা উত্থান-পতনে এসব ঘটনার ইতিহাস তাৎপর্য হারিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যাবে। ইতিহাসে এমন দুঃখজনক ঘটনাকে রহস্যাবৃত রেখে নির্বিকার থাকা উচিত নয়। এর একটি সত্যাসত্য অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই এর মীমাংসা হতে পারে। এখন বিএনপি হয়তো এটিকে ততটা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। বিষয়টি সে কারণে একটি রাজনৈতিক বিতর্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এর কোনো রাজনৈতিক ফায়দা দীর্ঘমেয়াদে কেউ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে হয় না। অনেকেই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এভাবেই ৪০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যেসব বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর নিরসন সম্ভব নয়। কেন নয় এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তারা দিচ্ছেন না। আবার নিকট-অতীতের এমন ঘটনার প্রকৃত তথ্য জানা ও উদঘাটনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে সমস্যাটির প্রকৃত ধারণা পাওয়ার উপায় রয়েছে। অথচ সেই পথে অনেকেই যেতে চাচ্ছেন না। এই বিষয় সম্পর্কে জানেন, অনেক কিছু দেখেছেন, কিংবা সেই সময়ের ঘটনাবলি সরকারের কিংবা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সংরক্ষিত যা কিছু রয়েছে তার ভিত্তিতে অনেক কিছুই উদঘাটন করা সম্ভব। এমনকি চট্টগ্রামের যে স্থানে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের অযত্ন-অবহেলায় স্মাহিত করা হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে সেখানেও ডিএনএ পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট সুযোগ থাকার কথা। যদি সে ধরনের সুযোগ থেকে থাকে তাহলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার কেন করা হবে না। তাছাড়া লাশের সুরতহালসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের ভাষ্যও শোনা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তাই তখন এর অনেক কিছু কাছ থেকে দেখেছেন বা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যারা বেঁচে থাকবেন না তাদের থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগও তখন হারিয়ে যাবে। তবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সেই সময়ের সরকারি দলিলপত্র, নথিপত্র, চিঠিপত্র, তথ্যসূত্র হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। তখন কিংবা পরবর্তী সময়ে সরকার কোনো মামলা অথবা তদন্ত কমিশন গঠন না করলেও এখন আইন অনুযায়ী মামলা কিংবা তদন্ত কমিশন গঠন করে সামগ্রিক ওই ঘটনাবলির রহস্য উদঘাটন করার উদ্যোগ বর্তমান সরকার নিতে পারে। সেটি অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত এবং বিতর্ক নিরসনের সঠিক উপায় বলে আমাদের কাছে মনে হয়। ভবিষ্যতে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ বিভ্রান্তিতে না থাকুক কিংবা জিয়াউর রহমানের লাশ বর্তমান সমাধিতে আছে কিনা সেটিও সবার কাছেই নিরসন হওয়া উচিত। সর্বশেষ যে বিষয়টি নিয়ে বিএনপি অহেতুক বিতর্ক করছে সেটি ইতিহাসে স্থান পাওয়ার বিষয় নয়। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে বিএনপি যে রাজনীতিটি করছে সেটিও ইতিহাসসম্মত নয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে বার্তাটি দিয়েছিলেন সেটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল। এটি একটি দালিলিক প্রমাণ। তাছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার আইনগত ভিত্তি এই আন্দোলনের প্রধান নেতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল। সেটি তিনি তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যেভাবে হোক তারবার্তা প্রেরণের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। সারা বিশ্ব ২৬ তারিখে জানতেও পেরেছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ তারিখে বেতার ভাষণে সেই জন্য বঙ্গবন্ধুকে শাস্তি দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সরকার তার অনুপস্থিতিতেও তাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। একইসঙ্গে ১০ এপ্রিল তারিখে গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা লিপিবদ্ধ আছে। এটি আমাদের সংবিধানেও রয়েছে। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের যেই পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল তাতেও ’৭১-এর ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্র অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর অন্য কারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া কিংবা কোনো বেতারে পঠিত ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণার মর্যাদা দেয়া একেবারেই ইতিহাসবিরোধী অবস্থানে নিজেদের দাঁড় করানো। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোনো বিতর্ক বিএনপিও করেনি। জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায়ও কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ তারিখে তার পঠিত ঘোষণাকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষণা বলে দাবি করেননি। বেতারে দেয়া প্রথমে এম এ হান্নান এবং জিয়াউর রহমানের ঘোষণা পাঠ করার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার একটি তাৎপর্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাদের কারো ডাকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি বা জনগণও যুদ্ধে অংশ নেয়নি। মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে। এর ক্ষেত্র অনেকটাই তিনি ৭ মার্চ তারিখে তৈরি করে রেখেছিলেন, সুতরাং এতসব ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বাস্তবতায় বিদ্যমান থাকার পরও বিএনপি ১৯৯১-এর পর থেকে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে আসছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী ২০ বছর কেন জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে কেউ উল্লেখ করেনি? ইতিহাস তো এভাবে মনগড়া তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App