×

মুক্তচিন্তা

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২১, ০৮:০৫ এএম

বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ চর্চার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে ব্রিটিশ উপনিবেশিককালে এই চর্চা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রজনতাসহ মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশ সমাজতন্ত্রকে আগ্রহ ভরে গ্রহণ করে। সে আগ্রহের প্রতিফলন ঘটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে। সমাজতন্ত্রের রূপ, ধরন ও চরিত্র নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও বিরোধী বা সরকারি সব রাজনৈতিক দল লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমাজতন্ত্রের সমর্থক দলগুলো একদিকে যেমন ছিল নানা উপদলে বিভক্ত, অন্যদিকে সামরিক শাসকদের নির্যাতন ও প্রলোভনে পড়ে অনেকেই সমাজতন্ত্রের নীতি ও আদর্শ পরিত্যাগ করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের অংশীদার হন। আর এভাবেই বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। বাম দলগুলো সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করলেও তা জনগণের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন এবং প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের জনসভাগুলোতে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, তখন তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় এবং শ্রমজীবী মানুষের মনে নতুন আশা-আকাক্সক্ষার সঞ্চার হয়। ধর্মভিত্তিক যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীরা আন্দোলন করেন, সেই পাকিস্তান হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাদের মোহ ভাঙতে শুরু করে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানিরা যে বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জাতিকে মূকবধির বানাতে চায়। বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস করে পঙ্গু জাতিতে পরিণত করতে চায়- এটা তার বুঝতে বাকি রইল না। তারপর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালির আসল আত্মপরিচয় ও বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটে। উল্লিখিত প্রতিটি আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার জন্য যে লোকটি সারাটা জীবন জেল খাটেন, সংসার ত্যাগ করে কারাগারের নির্জন সেলে জীবন কাটান তিনিই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। তিনি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের বন্ধু। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করায় তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের মধ্যরাতে। তিনিই ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জনগণ তাঁর আহ্বানে অস্ত্র হাতে নেয়। ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্ত স্বদেশে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ায়। লাভ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত মানচিত্র। ২ লাখ মা-বোনের অশ্রæ আলপনায় আঁকা সবুজ স্বদেশ। সেই দেশের কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে- এটা তিনি মোটেই বিশ্বাস করতেন না। বিদেশি গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে তাঁকে এ ব্যাপারে একাধিকবার সতর্ক করা হলে তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও চিলির আলেন্দে, কঙ্গোর লুমুম্বা, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন ও ভারতের মহাত্মা গান্ধীর হত্যার করুণ ইতিহাস তার অজানা ছিল না। ১৯৭৪ সালে তথাকথিত বিপ্লবীদের খুন, থানা লুট, বোমা হামলা, যেখানে-সেখানে অস্ত্রের ব্যবহার, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, বিদেশি দূতাবাস আক্রমণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি সংগঠন অবলীলা ক্রমে যখন ঘটিয়ে যায়, তখন স্বাধীনতার পক্ষের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাকশাল গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে জেলা গভর্নর নিয়োগ ক্ষেপিয়ে তুলে পাকিস্তানি ভাবধারার আমলাদের। সমবায় পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে তিনি যখন আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়াস চালান, ঠিক তখনই তাকে নির্মমভাবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁর ছোট ভাই শেখ নাসের, পুত্র কামাল, জামাল, শিশু রাসেলসহ ১৮ জনকে। অথচ কী আশ্চর্যের বিষয় সিঁড়িতে জাতির জনকের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতারাই মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত অবহেলা ও অনাদরে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রামে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে যায় সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। অশ্রæর বন্যায় ভেসে যায় বাংলাদেশ। মানুষের কান্নার ধ্বনিতে, অশ্রæর উত্তাপে বিষণ্ন-বিমর্ষ হয়ে ওঠে প্রকৃতি কারবালার কুয়াচ্ছন্ন প্রান্তের মতো। ১৯৫১ সালে শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন ভ্রমণের সময় তিনি বলেন, আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হবে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। চারিত্রিক দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো সমাজতান্ত্রিক দল নয়। মুসলিম লীগের একটি প্রগতিশীল অংশ মওলানা ভাসানী ও তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি দল গঠন করে। আওয়ামী লীগে এখন আর তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, আ. রাজ্জাক, শাহজাহান সিরাজের মতো প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নেতারা নেই। ছাত্র সংগঠনে নেই কোনো রাজনৈতিক পাঠচক্র। নেই প্রতিযোগিতা অন্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। হচ্ছে না নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সরকারি মিল-কারখানার শ্রমিক নেতারা আগের মতো সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা চিন্তাই করেন না। তাহলে সে আদর্শ কীভাবে বাস্তবতার মুখ দেখবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে আছে- আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমান শোষণ, বৈষম্য-অবিচার ও দুর্দশার হাত হতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই আদর্শ হচ্ছে একটি বিপ্লবী আদর্শ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া এই আদর্শ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে কি? চীন, রাশিয়া, কিউবায় বিপ্লবের মাধ্যমে পুরনো ব্যবস্থা বদলানো হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে নতুন ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সব মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণের একবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী- এই প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকেও দিশাহারা করে ফেলে। পরে তিনি পথের সন্ধান পান। তাঁর কোনো কোনো সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণিসংগ্রামের কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেন জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাহবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। তবে জবাবে তিনি বলেন, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলেন, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র অপরিহার্য। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়। সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলেছে সমাজতন্ত্র। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। মার্কসের মতে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির শোষণ ও দারিদ্র্য যত বাড়বে, তত তীক্ষè ও তীব্রতর হয়ে উঠবে সামাজিক বিরোধ। মুক্তি আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির দায়িত্ব বেড়ে যাবে। এই বিরোধ ও সংকট শান্তিপূর্ণ সমন্বয়ে মেটে না; একমাত্র বিপ্লব ছাড়া এ বিরোধের জন্য কোনো উপায় নেই। মার্কস দেখালেন- শোষণ, দারিদ্র্য, শ্রেণিবৈষম্য পুঁজিবাদের অপরিহার্য অঙ্গ। সুতরাং এই শোষণ, দারিদ্র্য ও শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে হলে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মূলে যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা তাকে একেবারে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা-চেতনা ও ভাবনার সঙ্গে কার্ল মার্কস, লেনিন ও মাও সেতুংয়ের বাস্তব চিন্তার এখানেই মৌলিক পার্থক্য এবং পথ ও পদ্ধতির ভিন্নতা। নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App