×

মুক্তচিন্তা

উন্নতির মহা হৈচৈ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২১, ০৮:০৬ এএম

মোট কথা, বিশ্বব্যাপী উন্নতির মহা হৈচৈ চলছে কিন্তু মানুষের মৌলিক যে চাহিদা সেগুলোর দিকে মোটেই নজর দেয়া হয়নি। ফলে মানুষের জীবনে অনেক রকমের দুর্ভোগ ঘটেছে, তারই একটি এবং আপাতত সবচেয়ে মারাত্মকটি হচ্ছে এই করোনা ভাইরাস। অতর্কিতে হানা দিয়েছে এবং জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নতির গৌরবগাথাগুলো কেমন অন্তঃসারশূন্য, সভ্যতা নিজেই কেমন ভঙ্গুর ও অমানবিক। সকল রাষ্ট্রেরই শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী রয়েছে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহীদের (অর্থাৎ সরকারবিরোধীদের) ওপর অহর্নিশ চোখ রাখে, কিন্তু কোথায় কোনো রোগ যে প্রস্তুতি নিচ্ছে মানুষ মারবার জন্য তার খবর রাখে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল কাজটা এখন দাঁড়িয়েছে মানুষকে ভয় দেখানো; সংস্থার প্রধান বলেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে করোনার এই আক্রমণ হচ্ছে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খাঁটি কথা। কোনো অতিশয়োক্তি নেই। বলেননি, তবে বলতে পারতেন যে আসলে এটি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আশঙ্কা ছিল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বাধবে। একুশ বছর পরে সে আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও শোনা যাচ্ছিল আরেকটি যুদ্ধ আসছে। রাখালেরা ভয় দেখাচ্ছিল। পঁচাত্তর বছর পর রাখাল-কথিত সেই বাঘটি সত্যি সত্যি অতর্কিতে হামলা করেছে। বাঘটি অদৃশ্য। যুদ্ধবাজরা যুদ্ধকে ছায়া-যুদ্ধের চরিত্র দেবার সাধনাতে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছে। তারা ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন, ধ্বংসকার্যে ড্রোনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, পারমাণবিক বোমা, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রকে শক্তিশালীকরণ ইত্যাদির গবেষণাতে যত অর্থব্যয় করেছে তার সবটাই তো দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত শত্রæ-মিত্র কাউকেই নিরাপত্তা দিচ্ছে না। সবটাই অপচয়। করোনার আক্রমণ ঠেকাতে ওসব প্রস্তুতি বিন্দুমাত্র কাজে লাগেনি। পুঁজিবাদীরা যে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে তা দিয়ে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য জীবাণুর মোকাবিলা করার প্রশ্নই ওঠে না। সীমান্তে সশস্ত্র পাহারা, কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল তোলা, সীমান্তে মানুষ হত্যা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বাধীনতা, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদ- চূড়ান্ত বিচারে এসব মস্ত মস্ত কথা যে অর্থহীন আড়ম্বর মাত্র করোনার আক্রমণ সেটা রাষ্ট্রকর্তাদেরকে একেবারে ঘাড়ে ধরেই বুঝিয়ে দিল। কর্তারা অবশ্য এই বুঝটাকে পাত্তা দেবে না। তাদের কান স্বার্থের ময়লাতে ঠাসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আওয়াজটা ছিল গণতন্ত্রকে বাঁচাও। তৃতীয় এই বিশ্বযুদ্ধের অনুচ্চারিত আওয়াজটি হচ্ছে মানুষকে বাঁচাও। সভ্যতার আচ্ছাদনের অন্তরালে যে বন্য নৃশংসতা বিদ্যমান আগের বিশ্বযুদ্ধ দুটি তাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল, মানুষের সযতœলালিত অনেক মূল্যবোধই তখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, এমনকি ধার্মিকদের মনেও ঈশ্বরের কথিত মহানুভবতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। সভ্য-বলে কথিত জাতিগুলো পরস্পরকে ধ্বংস করার উন্মত্ততায় মেতেছিল। এবারকার যুদ্ধ কিন্তু পুঁজিবাদীদের গৃহযুদ্ধের কারণে ঘটেনি। এই যুদ্ধে এক পক্ষ পুঁজিবাদ নিজে, অপর পক্ষ সমগ্র মানবজাতি। করোনা মহামারি আক্রমণটা করেছে ওপরের আচ্ছাদনকে নয়, ভেতরের সভ্যতাকেই। জানিয়ে দিয়েছে মানুষ কতটা স্বার্থপর হতে পারে, এবং সেই স্বার্থপরতার কাছে সামাজিকতা ও সহমর্মিতা কেমন ঠুনকো ও বর্জনীয় বিষয়। এই যুদ্ধ মানুষকে নিয়ে গেছে তার আদিম গুহায়, যেখানে লাখ লাখ বছরের সাধনায় অর্জিত গৌরবগুলোর জন্য কোনো স্থান নেই, সকল স্থান দখল করে নিয়েছে একটি মাত্র অনুভূতি, সেটা হচ্ছে নিজেকে বাঁচাও। বিপদে পড়লে মানুষের ওই দশা হয় বৈকি, হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিপদে একজন দুজন মানুষ পড়েনি, পড়েছে সমগ্র মানবজাতি। এই যুদ্ধ কি বলে দিল যে জাতিভেদ মিথ্যা, সকল মানুষই এক জাতি? এও কি বলল যে শ্রেণিবিভাজনটাও কৃত্রিম; বিপদের মুখে সবাই সমান? বলেছে হয়তো, কিন্তু এইসব বাণী কোনো কাজে লাগবে না। জাতিভেদ থাকবে, শ্রেণিভেদও ধ্বংস হয়ে যাবে না। কারণ যারা শাসন করে তারা সবাই উচ্চ শ্রেণির, শ্রেণি ভাঙলে তারাও ভাঙবে, সেই সর্বনাশটি তারা মানবে না। প্রাণপণে তারা তাই চাইবে শ্রেণিব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখতে। আর রাখতে গেলে মানুষে মানুষে পার্থক্যগুলোকে উচ্চে তুলে ধরা চাই। বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, দেশ- এসব পার্থক্য তাই থাকবেই। যেমন থাকবে বাজারের ফেলো কড়ি মাখো তেল নীতি। এগুলো শুধু থাকবেই না নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে। লক্ষণ ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। এ এক আশ্চর্য যুদ্ধ, যেখানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তেই আক্রান্তপক্ষ আত্মসমর্পণ করেছে। কেবল তাই নয়, আতঙ্কিত ও ছিন্নভিন্ন অবস্থায় তারা ছুটে গিয়ে আপন আপন গুহার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। জয় হয়েছে করোনার। এক সময়ে অবশ্য তার পরাভব ঘটবে। টিকা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। কিন্তু যে ক্ষতি সে করে গেল তার কি পূরণ ঘটবে? বিশ্ব অর্থনীতি বিধ্বস্ত, মানুষ্যত্ব পরাজিত ও ক্ষতবিক্ষত। ক্ষতি আগের দুটি বিশ্বযুদ্ধও করেছে। প্রথমটির পরে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল, দ্বিতীয়টির পরে অবিশ্বাস্য সব অনাচার ঘটেছে। যুদ্ধের সময়ে আমাদের এই বাংলায় যে মহামন্বন্তর ঘটেছিল, প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ত্রিশ লাখ মানুষ। তাতে কিন্তু গণতন্ত্রের ইঙ্গিত নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়নি। ফ্যাসিবাদ যে নিপাত যাবে তাও ঘটেনি, উল্টো বরঞ্চ ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সর্বত্রগামী হয়েছে। কিন্তু এবারের যুদ্ধে যা ঘটল সে তো কেবল বস্তুগত নয়, অত্যন্ত গভীরভাবে মনস্তাত্ত্বিকও। বস্তুগত ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। যে সময় ও সম্পদ হারিয়ে গেল তারা আর ফিরে আসবে না। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন অর্থনীতিতে এবার যে ধাক্কাটি লেগেছে তেমনটা গত দেড়শ বছরে কখনো ঘটেনি। বানিয়ে বলেননি, জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ থেকেই বলেছেন। কোটি কোটি মানুষ বেকার হবে, অর্ধ-বেকারের সংখ্যা হিসাব করা সম্ভব হবে না, খাদ্য থাকবে কিন্তু নিদারুণ অভাব ঘটবে ক্রয়-ক্ষমতার। এসবের লক্ষণ তো ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে। আর ধনবৈষম্য, দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার, নানা নামে লুণ্ঠনের যে বাস্তবতা এই মুহূর্তে বিদ্যমান সেসব আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে বাধ্য। কারণ যাই ঘটুক ব্যবস্থাটা বদলাবে না। আঘাত পেয়ে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে বলে যে আশাটা করা হয়েছিল সে-আশা ইতোমধ্যেই ক্ষীণ হয়ে যাওয়া শুরু করেছে। পুঁজিবাদী লুটেরারা বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না। ফলে দারিদ্র্য-মুক্তির উদারনৈতিক আশাটা যে কেবল ক্ষীণ হয়েই ক্ষান্ত হবে তা নয়, সে-আশা কুহকিনীতেই পরিণত হবে। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল-বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস উচ্চকণ্ঠে জানিয়েছিলেন, শুনে আমরাও উদ্দীপিত হয়েছি যে দারিদ্র্যকে তিনি জাদুঘরে বন্দি করে ছাড়বেন। একটা সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছিলেন বলে মন পড়ে, সেই সময় ইতোমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়েছে কি না স্মরণ করতে পারছি না, কিন্তু এটা তো দেখতে পাচ্ছি, করোনা দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়েই যে, দারিদ্র্য জাদুঘরে আটকা পড়া তো দূরের কথা, কোটি কোটি মানুষকে সে বন্দি করেছে তার কঠিন কারাগারে এবং ইউনূস সাহেবদের আশাবাদই বরং জাদুঘরে স্থান পাবে বলে মনে হচ্ছে, স্থানাভাব যদি না-ঘটে। উদারনীতির-ভদ্রস্বভাব মানুষদের কেউ কেউ দেখছি আশা করছেন পৃথিবীটা বদলাবে ঠিকই, তবে ভালোর দিকেই যাবে। কারণ মানুষ বুঝবে যে ভুল হয়ে গেছে, মস্ত বড় ভুল। উচিত ছিল সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে ব্যয় বাড়ানো। এই আশাবাদীরা ভরসা করছেন ভ্রান্তির এই বোধ থেকে বিশ্বশাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। কারো কারো এমনও আশা যে, করোনা এটি ধরিয়ে দেবে যে, শ্রেণিবৈষম্যের দরুনই রাষ্ট্রশাসকেরা জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করতে পেরেছে এবং সেই উন্মোচনটির ফলে শ্রেণিবৈষম্য একেবারে নির্মূল হয়ে না গেলেও অনেকটাই কমে আসবে। বলাবাহুল্য এগুলো সবই সুখ-স্বপ্ন। উদারনীতিকদের স্বপ্ন-বিলাস। বাস্তবে এসবের কোনো কিছুই ঘটবে না। রাষ্ট্রশাসকরা মোটেই পরিবর্তিত হবে না। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিপত্তিটা ঘটবে এই উদারনীতিরই। পৃথিবী ভাগ হয়ে যাবে এপক্ষে ওপক্ষে এবং সেই ফাঁকে পড়ে বেচারা উদারনীতি হয়তো শুকিয়েই মরবে। অনাহারে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App