×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সহায়ক : ভারত-সোভিয়েত চুক্তি, আগস্ট ১৯৭১

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২১, ১২:১১ এএম

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আগস্ট ১৯৭১-এ সম্পাদিত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গ্যারি জে বাসের ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : ইন্ডিয়াস সিক্রেট ওয়্যার ইন ইস্ট পাকিস্তান’ থেকে এই চুক্তিটির প্রেক্ষাপট ঈষৎ সংক্ষেপে ভাষান্তর করা হচ্ছে এবং এই রচনার বাইরের সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ যোগ করা হচ্ছে। ‘ভিয়েতনামের কসাই বাংলাদেশের কসাইর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং পরস্পরের সান্নিধ্যে দুই কসাই বেশ আরাম বোধ করছেন।’ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার একজন লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘ইয়াহিয়াও হিটলারের মতো দানবীয় অপরাধে অপরাধী।’ প্রতিবাদকারী জয়প্রকাশ নারায়ণ ঘোষণা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারাই বড় মাপের ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এখন যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু বিবেচনা করতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল এবং পাকিস্তানের একনায়কত্বকে সমর্থন করে আসছিল ভারতীয় কর্মকৌশলবিদরা তাতে নাখোশ ছিলেন, এখন তাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরিচালিত ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের শাসনকে এক পাল্লায় মাপতে শুরু করেছেন। আগে ভারতীয়দের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি ছিল, এখন তা নেমে গেছে। পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত সরবরাহ ভারতীয়দের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন এটা আবিষ্কৃত হলো যে ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্য পরিবহনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কমার্স ডিপার্টমেন্ট পাকিস্তানকে দুটি ৭০৭ বোয়িং উড়োজাহাজ ইজারা দিয়েছে ভারতীয় পার্লামেন্ট ফুঁসে উঠেছে। অনেক সংবাদই বিকৃত অসত্য; ভারতীয় গণমাধ্যম কখনো উসকানিমূলক সংবাদ পরিবেশনও করেছে থাকে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রই সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পরিবহন করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ভিয়েতনাম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসছে। হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন : ‘পাকিস্তানে আমাদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ নীতি কেবল একটি বিষয়ই নয়। এতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটেছে।’ এটা ‘আবেগসম্পৃক্ত বড় ধরনের প্রতীকী বিষয়’- বহু ভারতীয়ের কাছে আমাদের ‘অস্ত্রের পাকিস্তানে প্রবেশ মূলত বাঙালিদের দমিয়ে রাখার জন্য’। বাস্তবিকই ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রণালয় সঙ্গোপনে এই যুক্তিই প্রচার করে যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের পরিমাণ যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র যে পাকিস্তানকে সমর্থন জোগাচ্ছে এবং বাঙালিদের ওপর সামরিক আক্রমণকে অনুমোদন করেছে প্রতীকী অর্থে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পাকিস্তান সরকার যেমন তা মনে করছে বাঙালিরাও তাই মনে করেছে। এমনকি সজ্জন হিসেবে চিহ্নিত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ভারতীয় পার্লামেন্টে বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বাংলাদেশে গণহত্যা ক্ষমা করে দেবার এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আরো হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিয়ে যাবার অনুমোদন প্রদানের সমতুল্য। এমনকি তা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ওপর আক্রমণ পরিচালনার শামিল।’

আগস্ট চুক্তি : ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমের দেশগুলোর রাজধানী সফর করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পি এন হাকসার তাকে পাশ্চাত্যের সফরের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিলেন, তিনিই একই সঙ্গে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের আমন্ত্রণটিও বকুল করতে ইন্দিরাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। সোভিয়েত আমন্ত্রণে ইন্দিরা গান্ধীকে মস্কোতে ‘পিপলস ওয়েলকাম’- জনতার অভ্যর্থনার কথা বলা হয়েছিল। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমাগত নিবিড় হচ্ছে; সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসে উৎফুল্ল অবস্থা বিরাজ করছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মস্কোতে ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি (দুর্গা প্রসাদ) ধর কাজটা সেরে ফেলার জন্য মাসের পর মাস ধরে তদবির করে চলেছিলেন, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন তেমন জরুরি কাজ বলে মনে করছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের মুখোমুখি এবং তিনি অনুভব করছেন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই ভারতের ব্যাপারে শত্রু ভাবাপন্ন। কিসিঞ্জারের বরফ গলানো বেইজিং (তখন পিকিং) সফরের পর এটাও স্পষ্ট হয়ে হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সম্মিলিতভাবে ভারতের প্রতি বৈরী আচরণ করতে পারে। কাজেই আগস্টের প্রথম দিকে ডি পি ধর দিল্লি থেকে মস্কো ছুটলেন- চুক্তিনামা চূড়ান্ত করতে হবে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী কে সি পান্থ বললেন, এটা একটা প্রায়োগিক পদক্ষেপ, যেহেতু ভারতকে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে এটা সম্পাদন করা জরুরি। মস্কো বৈঠকে ধর ছিলেন উচ্ছ্বসিত। সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর পাকিস্তানের গণহত্যা চালানোর নিন্দা করলেন আর পাকিস্তানকে জাহাজ বোঝাই অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রেরও নিন্দা করলেন। তিনি আরো বললেন, এই মৈত্রী চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান ভয়ংকর চটে যাবে। বড় বন্ধুত্ব বড় ঈর্ষাকেই আমন্ত্রণ জানায়। প্রয়োজনের সময় সোভিয়েত সহায়তার কথা ভারতীরা সাদরে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ থাকে, সে সময় কিন্তু ভারতের দ্রুত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সোভিয়েত নেতৃত্ব পছন্দ করেনি। সংকটের পুরো সময়টাতে লিওনিদ ব্রেজনেভ ও সরকার যুদ্ধ নিয়ে সতর্ক ছিলেন- পাকিস্তান দু’টুকরো হয়ে যাবে এবং তা হজম করার মতো অবস্থায় তারা ছিলেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও সম্মত ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সূত্রে প্রধানমন্ত্রী আলোক্সি কোসিগিন বললেন, তাদের সীমান্তে কী হচ্ছে ভারত তো তা সম্পূর্ণ গোপন রাখছে- এটা ছিল অস্বস্তিকর বক্তব্য। কোসিগিন যুদ্ধে ভারতকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বরং ভারতকে তার সেনাবাহিনী শক্তিশালী করার পরামর্শ দিলেন। এই চূড়ান্ত মুহূর্তেও তিনি শান্তি বজায় রাখার অনিবার্যতার পুনরোক্তি করেন এবং মুখের ওপর বলে দেন যুদ্ধটা তো ভারতের স্বার্থে নয়। মাত্র এই একটি ইস্যুতেই দুই দেশের অবস্থান বিপরীতমুখী। তারপরও ৮ আগস্ট ১৯৭১ সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদ্রেই গ্রোমিকো দিল্লিতে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত। এ সময় সোৎসাহে হাকসার প্রধানমন্ত্রী গান্ধীকে বললেন, এটি সর্বোচ্চ গুরুত্বের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভারত যে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করছে এটা হাকসার রুশদের কাছে স্বীকার করলেন এবং মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন জোগাতে কতটা ব্যয় হচ্ছে সেটাও একান্তে জানালেন। হাকসার তাকে পাকিস্তানের নির্মমতার কথা বললেন এবং ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর জনগণের চাপের কথা বললেন, যা সোভিয়েত স্বৈরশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী আদ্রেই গ্রোমিকোর পুরোপুরি বোধগম্য হবার কথা নয়। হাকসার সোভিয়েত সমর্থন পেয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন, ঝুঁকিটা ততটা বিবেচনায় আনলেন না যে এতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বন্দ্বটি আরো জোরদার করে তুলতে পারে। মিসেস গান্ধী ও হাকসার অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তার চুক্তিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং চীনারা অবশ্যই ভীষণ ক্ষিপ্ত হবেন। ইন্দিরা গান্ধীর দুপাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির দুই স্থপতি পি এন হাকসার এবং ডি পি ধর, একই সঙ্গে সোভিয়েতপন্থি পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোকে দিল্লিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। ভারতের যুদ্ধযাত্রা নিয়ে উদ্বিগ্ন গ্রোমিকোকে প্রধানমন্ত্রী আশ^স্ত করলেন এই চুক্তি শান্তি এনে দেবে। তবে এ কথাও তিনি গ্রোমিকোকে বললেন যে তিনি নিজেকে ভারতীয় জনগণের চাপে পড়া একটি দ্বীপ ভাবতে শুরু করেছেন- তাদেরও চাওয়া তিনি যেন জঙ্গি পথে না হাঁটেন। হাকসার আশা প্রকাশ করলেন, এই চুক্তি হয় যুদ্ধ ঠেকাবে কিংবা ভারতকে বিজয়ী হতে সাহায্য করবে। প্রকারান্তরে তা বাংলাদেশের সহায়ক হবে। ভারতীয় রেকর্ডস থেকে স্পষ্টতই জানা যায় যুদ্ধ শুরুর একটি অনুমোদন তারা প্রত্যাশা করছিল কিন্তু গ্রোমিকো তাতে সম্মত হননি। তিনি শান্তিকামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করলেন এবং বললেন যারা শান্তি চান তারা এই চুক্তিকে অপছন্দ করতে পারেন না। তারপরও গ্রোমিকো তাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী দেশকে উপহার বঞ্চিত করলেন না। শরণার্থীদের জন্য সোভিয়েত সাহায্য সামান্য হলেও কিছু সামরিক উপহার সাধলেন : গোলন্দাজ বাহিনী সহায়তা অস্ত্র, প্যাট্রল শিপ, সামরিক হেলিকপ্টার- তবে এর কিছুই আসন্ন যুদ্ধকালে মিলবে না। উপমহাদেশকে আণবিক শক্তিধর করে তুলতে গ্রোমিকো বিপুল পরিমাণ ‘হেভি ওয়াটার’ সাধলেন, যা ‘আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ বিকাশে’ ব্যবহৃত হবে। ৯ আগস্ট ১৯৭১ সর্দার শরণ সিং এবং আদ্রেই গ্রোমিকো ‘ট্রিটি অব পিস, ফ্রেন্ডশিপ এন্ড কো-অপারেশন’ স্বাক্ষর করলেন। এই চুক্তিটি সুনির্দিষ্ট নয় বরং বলা যায় তা একটি বায়বীয় দলিল যাতে দুই রাষ্ট্র একান্ত বন্ধুত্ব, সুপ্রতিবেশীগুণসম্পন্ন এবং সম্পূর্ণ সহযোগিতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যদি চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের কোনো একটি আক্রান্ত হয় তাহলে এ ধরনের হুমকি অপসারণের জন্য অপর দেশ আলোচনা করবে এবং তাদের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এতে প্রকৃতপক্ষে প্রতিরক্ষার সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ঘাটতি থাকলেও মস্কোতে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস এই চুক্তিকে চীন ও পাকিস্তান উভয় দেশের প্রতি প্রতিরোধক সতর্কবাণী। এখনো বহু ভারতীয় সোভিয়েতের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদনকে একটি বিশেষ উদযাপন হিসেবে বিবেচনা করেন। হাকসার লিখেছেন, ‘এতে অনেক আশা সঞ্চারিত হবে।’ ভারতীয় কূটনীতিকরা জানিয়েছেন চুক্তিটি ইসলামাবাদকে বাস্তবিক আঘাত প্রদান করেছে। মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেছেন, ‘রুশরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের জন্য উপকারী হবার চেষ্টা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আসন্ন চীন সফর সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক করল, পাকিস্তানে মুজিবকে বিচারে সোপর্দ করা নিয়ে ভারতীয় প্রতিবাদে তারাও সাড়া দিল। গ্রোমিকো তার আসন্ন পাকিস্তান সফর বাতিল করতে সম্মত হলেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট দ্রুত এই চুক্তি অনুমোদন করল, এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর কট্টর সমালোচক জয়প্রকাশ নারায়ণ চুক্তিকে স্বাগত জানালেন এবং তখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সবচেয়ে ভালো সময় বলে দাবি করলেন। তবে পার্লামেন্টে কেউ কেউ মনে করলেন এই চুক্তি ভারতীয় স্বাধীনতা খর্ব করবে এবং সোভিয়েত সম্মতি ছাড়া বড় কোনো কাজ করতে পারবে না। জনসংঘসহ ছোট কয়েকটি দল বলল ভারত ব্রিটিশ তাড়িয়ে সোভিয়েত উপনিবেশ হতে যাচ্ছে। এটাও বলা হলো সোভিয়েত ট্যাংকের নিচে চাপা পড়ার আগে হাঙ্গেরি ও চেকোসেøাভাকিয়াও অনুরূপ চুক্তি সম্পাদন করেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন মৈত্রী আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে ভারতের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী আবশ্যক ছিল। অন্তত এই চুক্তির সূত্রে সোভিয়েত নৌবাহিনীর তৎপরতা মার্কিন রণনৌবহর- সেভেন্থ ফ্লিটের তৎপরতা কেবল পর্যবেক্ষণের মধ্যে সীমিত রাখতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পূর্ব পাকিস্তানে লেফেটন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির আমেরিকান সহায়তা স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ১২ অনুচ্ছেদের ভারত-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির একাদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চুক্তির মেয়াদ ২০ বছর এবং চুক্তিবদ্ধ পক্ষের কোনো আপত্তি না থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৫ বছর করে নবায়িত হতে থাকবে। ঠিক ২০ বছর পর ১৯৯১ সালের ৮ আগস্ট চুক্তিটি পুনরায় ২০ বছরের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নবায়ন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ১৯৯৩-এর জানুয়ারিতে রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিনের নয়াদিল্লি সফরকালে পুরনো চুক্তিতে সংশোধনী এনে তা ভারত-রুশ ফেডারেশন বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নামকরণ করা হয়, একই সঙ্গে অনুচ্ছেদটি বাদ দেয়া হয়। সোভিয়েত-ভারত ও রুশ-ভারত সম্পর্কের স্বর্ণ যুগের সমাপ্তি ঘটেছে আশির দশকের শেষেই। রাশিয়া এখন সন্দিহান চোখে ভারতের দিকে তাকায়। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য ১৯৭১-এর ৮ আগস্ট চুক্তিটি সম্পাদিত না হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধটা পিছিয়ে যেত, সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাও বিলম্বিত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বছরে ৫০ বছর আগের ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্মরণ করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App