×

মুক্তচিন্তা

মৃত্যুকে অভ্যাসে পরিণত করার সময় কি আসন্ন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ১২:০৪ এএম

এখনো আমরা নিজেদের বাঙালি বলে গর্ববোধ করি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, শেখ মুজিব আমাদের অহংকার। তাদের শিক্ষাই আমাদের মধ্যে জাগিয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধ; তৈরি করেছে বিপদের দিনে মানুষের পাশে থাকার মূল্যবোধ। সেজন্যই বাংলাকে তেমন করে হিংসা ছুঁতে পারেনি। বাংলাদেশ ছিল সবসময় অবিচল। একবার নয়, দুবার নয়- এ দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে বহুবার। ফের একবার কঠিন পরীক্ষার মুখে আমরা দাঁড়িয়ে। করোনার ছোবলের মতো এমন সংকটে বাংলাদেশ ইতোপূর্বে কখনো পড়েনি। এ অবস্থায় করোনাই আমাদের সবার প্রতিপক্ষ। রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ, প্রশাসনিক মতবিরোধ এসবের আর কোনো জায়গাই নেই এখন। এখন সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। বদলে গিয়েছে মানুষের চাহিদাও। সোনাদানা, গাড়ি-বাড়ির চেয়েও বহু মানুষের কাছে মূল্যবান এখন অক্সিজেনের সিলিন্ডার। যে ছবি আমাদের চারপাশে ছিল, তাতে কিন্তু একটি উপন্যাস অথবা সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ তৈরি করাই যায়। একটি দেশের কাহিনীÑ চিকিৎসার অভাবে হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় রাস্তায় মানুষ পড়ে আছে। হাসপাতালে জায়গা নেই। দলে দলে মৃত্যুর মিছিল। চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি থাকা বহু রোগী মাঝেমধ্যেই অক্সিজেন পেতে পেতে হঠাৎ বুঝতে পারছে, আর তো অক্সিজেন নেই! চোখের সামনে তারা আলো, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ডাক্তার, নার্স, পরিবারের ক্রন্দনরত মুখের চেনা ছবি এসব দেখতে দেখতে একসময় শ্বাস নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে। ৫০০ টাকার একটি ওষুধ ৫০ হাজার টাকা চাওয়ায় অসহায় পুত্র, পিতা, মা, বোন, ভাইয়েরা সেই কালোবাজারির হাতে-পায়ে ধরছে একটু দাম কমাতে। অক্সিজেনের চড়া দাম মেটাতে নারী তার স্বামীকে বাঁচাতে গয়না বিক্রি করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। পরবর্তীতে এমন উপন্যাস পড়লে অথবা সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ দেখলে আমাদের গা শিউরে উঠবে না তো! এই ধাঁচের সিনেমা অথবা উপন্যাসকে বলা হয় ‘ডিসটোপিয়া’। আমরা কি বুঝতে পারছি, অবশেষে আমরা নিজেরাই একটি ডিসটোপিয়ায় ঢুকে পড়েছি? সময়টা এতটাই ভয়ংকর যে, মৃত্যুর মিছিল আমাদের কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের কাছে ভয়ংকর সংবাদগুলো সহনীয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আশপাশের মানুষগুলো হঠাৎ করেই ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আমাদের চেনা লোকের মৃত্যুর খবরে কষ্ট, বেদনা, চমকে ওঠা, অবসাদে ভেঙে পড়ার প্রবণতা যেন স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা আর ততটা চমকাচ্ছি না, অতটা হাহাকারে ফেটে পড়ছি না! এটাই ভয়ংকর সময়ের লক্ষণ। এ যেন মৃত্যুকে অভ্যাসে পরিণত করার সময়। আমরা তো ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, কালাজ্বর, টাইফয়েড, যক্ষ্মা এসব নিত্যনৈমিত্তিক উপসর্গ নিয়ে বেঁচেছিলাম এতদিন। কিন্তু এবার করোনা এসবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। বলছে- দেখ, আমি আরো কত শক্তিশালী হতে পারি! এখন শুধু মানুষের নয়, অক্সিজেনেরও মড়ক চলছে দেশজুড়ে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সামান্য অক্সিজেন পৌঁছে দিতেও আমরা অপারগ! তাই অক্সিজেন আজ আর সামান্য নয়, জরুরি পণ্য হয়ে উঠেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে চরম সংকটের মুখে সবচেয়ে পাশে পাওয়া উচিত কাকে? রাষ্ট্রকে। আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, আমাদের জনগণ সেই রাষ্ট্রকে কতটা পাশে পেয়েছে। রাষ্ট্রকে কাছে পেয়ে করোনাকে পরাজিত করার অস্ত্র অনেক দেশই ইতোমধ্যে দেখতে সক্ষম হয়েছে। সবচেয়ে আগে যার নাম আসে, তা ইসরায়েল। ইসরায়েল অনেক আগেই করোনামুক্ত বলে ঘোষিত হয়েছে। মূলত দেশের প্রতিটি নাগরিককে প্রতিষেধক দিয়েই এ অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে দেশটি। ইসরায়েলের পথে হেঁটে আরো বেশকিছু দেশ নিজেদের করোনামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বা তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বেলজিয়াম তাদের মধ্যে একটি দেশ। ১০ লাখ আক্রান্ত এবং ২৫ হাজার মৃত্যুর খাতা খুলেও আজ বেলজিয়াম করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান। সাড়ে ৪ লাখ আক্রান্ত এবং ৭ হাজার মৃত্যুর হিসাব এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে তাদের দেশে। একই দৃশ্য দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে। আয়ারল্যান্ডের অবস্থাও তেমনই। শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে তারা মৃত্যুর সংখ্যা। ইউরোপের একটি ছোট দেশ মন্টেনেগ্রো। তাদেরও আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যা বর্তমানে শূন্যতে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানাও জয় করেছে করোনাকে। কেউ সেখানে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে না। ইউরোপের ফিনল্যান্ডও করোনাকে জয় করেছে। তাদের দেশেও আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা শূন্য। মধ্য আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনও করোনাকে পরাস্ত করতে অনেকটাই সফল হয়েছে। মধ্য আমেরিকার এল সালভাদর। উপকূলবর্তী এই ছোট্ট দেশেও এখন আর কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না। এছাড়া বতসোয়ানা, গ্যাবন, সুদান, কম্বোডিয়া, তাজিকিস্তান, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, মালি, চাদ, গাম্বিয়া, নিকারাগুয়া, সান মেরিনো, সেন্ট লুসিয়া, বার্বাডোস, বারমুডা, ডমিনিকা, পাপুয়া নিউ গিনি ইত্যাদি দেশে নতুন সংক্রমণ বন্ধ আছে। পাশাপাশি ভিন্ন চিত্রে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা। আক্রান্তের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত। ভারতের পরই ব্রাজিলের অবস্থান। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোভিড প্রভাব ফেলেছে ফ্রান্স ও ব্রিটেনে। কোভিড আক্রান্ত দেশগুলোতে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, রাজনৈতিক নেতাদের জন্যও সময়টা অত্যন্ত খারাপ। কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রাজিলসহ বহু দেশের সরকারই এখন নাগরিকদের রোষের মুখে। নাগরিক বিক্ষোভের চাপে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছে সেসব দেশের বড় বড় নেতা। গত মার্চে ইকুয়েডরের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন রোডল্ফো ফারফান। তিন মাস আগেই বসেছিলেন তিনি ওই পদে। অদ্ভুতভাবে তার আগে যিনি ওই পদে ছিলেন, তাকেও পদত্যাগ করতে হয়েছিল। দেশের কোভিড পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তির প্রয়োজন- এ কথা বলে গত এপ্রিল মাসে পদত্যাগ করেছিলেন অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুডল্ফ অ্যান্সচোবার। মে মাসে পদত্যাগ করেন ইরাকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসান আল-তামিমি। টিকাকরণের কর্মসূচিতে কিছু অসঙ্গতি প্রকাশ্যে আসতেই ফেব্রুয়ারি মাসে পদত্যাগ করেন আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জিনেস গোলজালেস গার্সিয়া। সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ছয়জন কোভিড রোগীর মৃত্যু হলে খোদ প্রধানমন্ত্রীর চাপে পড়ে পদত্যাগ করেন জর্ডানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পদত্যাগ করতে হয় পেরুর স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও। রুশ টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করায় শরিক দলের চাপে মার্চে পদত্যাগ করেন সেøাভোকিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে মা ও তার সদ্যজাত শিশুর মৃত্যু হলে জানুয়ারি মাসে গোটা মন্ত্রিসভাই পদত্যাগ করেছিল মঙ্গোলিয়ায়। কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর পদত্যাগ করেছিলেন নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল ও চেক প্রজাতন্ত্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা। কোভিড প্রশ্নে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন কানাডার পাবলিক হেলথ এজেন্সির প্রেসিডেন্টও। আজ বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের। সেই পরিণাম থেকে রক্ষা পেতে ইতিহাস এবং অন্যের উদাহরণকে অবহেলা করা বন্ধ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, একদিন স্মল পক্স ও প্লেগের কারণে রোমের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে চলতে থাকা দুর্ভিক্ষ, মহামারি, দাঙ্গা ও যুদ্ধ একসময় বৃহৎ রোম সাম্রাজ্যকে গো-চারণ ভূমিতে পরিণত করেছিল। সেসব ইতিহাস এবং করোনাকালে কিছু দেশের সফলতার উদাহরণকে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হিসেবে ধারণ করতে হবে বাংলাদেশকে। ইতোমধ্যেই মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে সম্পদের একতরফা সঞ্চয় ক্রমশ বাড়ছে। দারিদ্র্য ও জনঘনত্ব বাড়লেও স্বাস্থ্য-শিক্ষা-খাদ্য সুরক্ষা অবহেলিত। ধর্মের জিগির ও কুৎসিত বিভাজনের রাজনীতি জনমনে ক্রমশ নৈরাশ্য বাড়াচ্ছে। লকডাউন তৈরি করছে অর্থনৈতিক সংকট। কাজ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। কোভিড নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কে জনমনে অস্বচ্ছতা আছে। ভাইরাস ও ভ্যাকসিন নিয়ে রটছে নানা গুজব। তারপরও আশায় বুক বাঁধি শক্তভাবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে হয়তো একদিন করোনা অতিমারিকে মানুষ জয় করবে। অন্তিমে মনুষ্যত্ব টিকে যাবে, যাবেই।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App