×

মুক্তচিন্তা

কোন পথে হাঁটবে তালেবান এখনো নিশ্চিত নয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ১২:০৬ এএম

বিষয়টি লক্ষ করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ : তালেবানদের এ বিজয় প্রায় প্রতিরোধহীন, সামান্য ব্যতিক্রম বাদে। এ ঘটনা অভাবিত নয়, তেমনই অবিশ্বাস্য নয়। সর্বশেষ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময় এমন সম্ভাবনা তথা আশঙ্কা নিয়ে বলাবলি হচ্ছিল- বিশেষ করে যখন দেখা গেল এ সময় সরকারি বাহিনী থেকে আফগান সেনারা পালাতে শুরু করেছে। খবরটি ছোটখাটো হলেও নিঃসন্দেহে ছিল বিশেষ তাৎপর্য, একাধিক তাৎপর্যে সমৃদ্ধ। অর্থাৎ জনগণের আস্থা ছিল না, দুর্বল ও মার্কিনি অনুগত আফগান সরকারের ওপর। বুঝতে ভুল গণতন্ত্রী আফগান ও আধুনিক চেতনার আফগান নারীদের। তাদের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো, একের পর এক তালেবানদের শহর দখলের ঘটনায়। শেষ পর্যন্ত প্রায় বিনা বাধায় রাজধানী কাবুল বিজয়। আর এ এমন বিজয় যে ‘রক্তপাতহীন’ তথা কঠিন প্রতিরোধহীন হবে তা বলাই বাহুল্য। তালেবানদের এবারকার বিজয় নিয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, সমর্থক বা বিরোধী রাজনীতি-মনস্কদের মধ্যে। এ যেন কিছুটা হলেও গণপ্রজাতন্ত্রী মাদ্রিদের করুণ পতন দৃশ্যের সঙ্গে সমান্তরাল। পার্থক্য এটুক যে প্রগতিশীল বিশ্ব আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ ব্রিগেড তৈরি করে অনেক রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। দুর্ভাগ্য যে হিটলার মুসলিনির নগ্ন সশস্ত্র সমর্থনের মুখে তা টেকেনি। টেকেনি কার্যত ইঙ্গ-মার্কিন গণতন্ত্রী ভুবনের দুমুখো নীতির কারণে। কাজেই ফ্রাংকোর রক্তাক্ত বিজয়। আর এখানে বড় সমস্যা বিদেশি প্রভাবিত শাসন এবং অনুগত দুর্বল, স্বার্থপর সরকারের প্রতি সমর্থন জানাতে প্রস্তুত ছিল না আফগান জনতা, শিক্ষিত পেশাজীবী মানুষ। আমার ধারণা, সম্ভবত সরকারি বাহিনীর মধ্যেও ছিল ক্ষোভ, ছিল সেই সুবাদে তালেবানদের প্রতি নীরব সমর্থন। বহু ঘটনা তার প্রমাণ। আর তা না হলে মার্কিন সেনারা কাবুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এত দ্রুত কাবুলের পতন ঘটত না। ব্যতিক্রম আধুনিক আফগান নারী।

দুই. এই নারী সমাজ ও গণতন্ত্রী আফগানরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ঠিকই বলেছিল যে, তালেবানবিরোধী শক্তি, বিশেষত মার্কিনিরা তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাদের তালেবানদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বলা চলে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘রাজনৈতিক ডিল’, জো বাইডেনের ভাষ্যে, তার হাত-পা বাঁধা। এ দাবিও সঠিক নয়। এ ঘটনার কিছুটা হলেও তুলনীয় ১৯৪৭-এ কংগ্রেসের ভারত ভাগ মেনে নেয়ার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ পাখতুন (পাঠান) নেতা গাফফার খানের খেদোক্তি : এতদিনের সমর্থনের পরিণাম হলো- ‘আপনারা আমাদের নেকড়ের (জিন্নাহ মুসলিম লীগ) মুখে ফেলে দিলেন।’ গান্ধীর মুখে টুঁ শব্দটি ছিল না সেদিন। বর্তমান কাবুল পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ যদি এই সমর্থনের পটভূমিতে আফগান জাতীয়তাবাদের ছায়াপাত দেখতে চান, তাহলে সেটা বড় ভুল হবে। কারণ উগ্র ধর্মীয় তথা কট্টর শরিয়তি ধারার ধর্মান্ধ তালেবানদের রাজনীতিতে- তা পূর্বতন মোল্লা ওমরের হোক বা বর্তমান তালেবানেরই হোক জাতীয়তাবাদের (ন্যাশনালিজমের) নীতি বা আদর্শ বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষমতা দখল ও শাসন পরিচালনার উচ্চাশা। আর এই প্লাস পয়েন্টে তাদের প্রতি আফগানদের বড়সড় অংশের সমর্থন। একই কারণে সোভিয়েত সেনা সমর্থিত নজিবুল্লাহর জনবান্ধব সরকারকেও তারা সমর্থন জানায়নি। নিজ দেশের মাটিতে বিদেশি সেনার উপস্থিতি ও সমর্থন কেউ চায় না। ব্যতিক্রম দক্ষিণ কোরিয়ার শাসক ও জনগণ। এই বিদেশি অবস্থানের ফ্যাক্টর টুকুর সদব্যবহার করেছে আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আমার মনে হয় না, বর্তমান তালেবান ও পূর্বতন তালেবানদের মধ্যে কোনো ফারাক আছে রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে। যারা এ ধরনের মিথ্যা স্বপ্ন দেখছেন, তাদের ভুল খুব শিগগিরই ভাঙবে। ইতোমধ্যেই আমরা অসহায় আফগান নারীর চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছি। কিছুসংখ্যক নাগরিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবরও শোনা যাচ্ছে। তিন. একটি স্ববিরোধী বিষয়ের দুই প্রান্ত কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। তালেবানি শাসন, তাদের নীতি ও মতাদর্শের প্রতি সত্যিকার জনসমর্থনই যদি থাকবে তাহলে রাজধানী কাবুল ও একাধিক শহর ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে কেন? তাতেই প্রশ্ন উঠছে, তালেবান শাসনের প্রতি প্রকৃত রাজনৈতিক সমর্থন জনগণের দিক থেকে কতটুকু। আসলে বিদেশি অবস্থান জনিত পরোক্ষ তালেবান-সমর্থন প্রকৃত রাজনৈতিক চিত্র চরিত্র তুলে ধরে না। তালেবানদের পূর্বতন পাঁচ বছরের অনাধুনিক, ধর্মান্ধ শাসনের স্থলে যদি একটি দেশপ্রেমী-গণতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে আর যাই হোক, তেমন সরকার জনসমর্থন হারাতো না, সেনাবাহিনীতেও দুর্বলতা দেখা দিত না। তাঁবেদার সরকারের চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে কাবুল পতনের আভাস পেয়ে সরকারপ্রধান তথা প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগে। ‘আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন পেশার নারী-পুরুষের তালেবান বিষয়ক যে অভিজ্ঞতা চিত্র প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যম সূত্রে, তা আমাদের হিসাবের সঙ্গে মেলে, যা বড়রকম হতাশা চিত্র একই সঙ্গে আফগান পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিশনের এক নারী সদস্য খোলামেলা ভাষায় বলেছেন ‘বিশ^ আমাদের ধোঁকা দিয়েছে।’ মার্কিনি আন্তর্জাতিক নীতি তথা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের আত্মস্বার্থপর নীতি বরাবর একই রকম বেইমানির। অর্থাৎ স্বার্থ পূরণ শেষে ছুড়ে ফেলে দেয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এবার সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হবে শিক্ষিত নারী, পেশাজীবী নারীদের। ইতোমধ্যে খবর মিলছে স্বাধীনচেতা নারীদের হত্যা করার। গণতন্ত্রী বিশ^ কি চোখ বন্ধ করে এ জাতীয় বর্বর ঘটনা হজম করবে? এই হলো ‘রক্তপাতহীন কাবুল দখলের’ রাজনৈতিক আমলনামা তালেবানি শাসন শুরু হতে না হতেই। খবরে দেখছি, ‘উৎকণ্ঠ বিশ্ব’। নিছক তাত্ত্বিক উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় তো ফল মেলে না। অতীত ইতিহাস এমন বাস্তবচিত্রই আমাদের উপহার দিয়েছে। যা আমরা একদা দেখেছি স্পেনে, দেখেছি বিভাজনরত ভারত বর্ষে এবং একাধিক দেশে। এ পর্যন্ত তালেবানদের মনোভাব মধ্যপন্থার- ‘শত্রুতা নয়, সংঘাত নয়’। সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যদের ক্ষমতায় নেবার চিন্তা ইত্যাদি। তবে নারীদের সম্পর্কে ভাবনা অনেকটাই আগের মতো ‘নারীর অধিকার শরিয়ায়ই অনুযায়ী।’ এখানে ছাড় সামান্য বলা চলে। আধুনিকতা গ্রহণযোগ্য নয়। আর এজন্যই আফগান নারীসমাজ আতঙ্কে। কই, এ ব্যাপারে তো মালালার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। শুনছি না এমন আহ্বান : ‘প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, তোমার কন্যাদের বাঁচাও।’ আমরা বলি : টার্গেট গ্রুপের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে গা বাঁচাতে দিব্যি তো দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করে। ইতোমধ্যে খবরের কিছু আলামত বাস্তবিকই আতঙ্কের। তালেবান নীতি-নির্ধারকরা জানতে চাইছে আফগান নারী সমাজের বর্তমান স্ট্যাটাস- কিশোরী-তরুণী থেকে পেশাজীবী মহিলা পর্যন্ত। লক্ষণ সুবিধের নয় বলেই মনে হয়। অথচ পশ্চিমা বিশ্বকে আশ্বস্ত করছে নানা ভাষ্যে যাতে তারা মার্কিনি বা ন্যাটোর ড্রোন হামলার শিকার না হয়। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ তালেবান বিষয়ে বিভাজিত। এক গ্রুপ তালেবানদের স্বীকৃতি না দেয়ার পক্ষে, অন্য গ্রুপের অবস্থান বিপরীত। শেষোক্তের যুক্তি- এদিকে কঠোরতা তাদেরকেও কঠোর করবে, ভুগবে আফগান নর-নারী। সত্যি তালেবানি কাবুল বিরাট সমস্যা তৈরি করেছে, যাকে বলে উভয় সংকট। এ মুহূর্তে অপেক্ষা এবং ঘটনার ওপর নজরদারি ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই। কারণ হিসাব-নিকাশ না করেই ‘পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে।’ তবে জনবান্ধব পক্ষকে সতর্ক ও তৎপরতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App