×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি : মূল্যায়নের এখনই সময়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২১, ১২:২১ এএম

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে উপনীত করান। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, বাংলা নামের দেশটির জন্য স্বাধীনতা এনে বঙ্গবন্ধু অবসরে যাওয়ার কথা ভাবেননি, যা কিনা আমরা তাঁর সমকালের কোনো কোনো নেতার জীবনে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু এই পর্যায়ের মূল কাজ হিসেবে অর্থাৎ মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ হিসেবে নির্ধারণ করেন, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা এবং এর সুফল যাতে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর কাছে এক কথায় মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় ছিল, অর্থনৈতিক মুক্তি। তবে মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসেও জাতীয় প্রশ্নগুলো বাদ হয়ে যায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি সত্য ছিল। তাই বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতাকে সংহত ও অর্থবহ করার জন্যই অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, পরাশক্তিকে মোকাবিলা করতে হলে, নয়া উপনিবেশিকতা প্রতিহত করতে হলে পুঁজিবাদী পথে অথবা জোরদারি মহাজনী পথা চালু রেখে সম্ভব নয়। পরাশক্তিরা সবসময় পুঁজিপতিদের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ, জাতীয় স্বার্থবিরোধী মুৎসুদ্দি আমলা ও পরগাছা পুঁজি এবং সামন্ততন্ত্রের অবশেষসহ পশ্চাৎপদ সামাজিক অবকাঠামো রক্ষা করতে আগ্রহী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধে। এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিহত করার জন্যই তাদের সামাজিক ভিত্তিতে আঘাত আনতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সমাজের মৌলিক রূপান্তরের কর্মসূচির ভিত্তিতে শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবেই জানতেন, বাস্তবে এবং প্রচলিত পথে হেঁটে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা খুবই সহজ কাজ না। এই ঐক্য মুক্তিসংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যত ব্যাপক এবং স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় ধাপে তত ব্যাপক হবে না, হতে পারে না। অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীকটি অন্তর্নিহিত থাকলেও তা অনেকটা দূরে ছিল। ১৯৭৫ সালে সমাজবিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সবকিছু জেনেশুনে স্বভাবসিদ্ধভাবে একটু বেশিই ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন। বাঙালি জাতির ওপর মাত্রাতিরিক্ত বিশ^াস থেকেই বঙ্গবন্ধু সব জেনেবুঝেই এই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ^াসের মর্যাদা রাখেনি। ফলস্বরূপ, প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে পারেনি। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি বা সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের প্রশ্নটি বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে স্বাধীনতাকে প্রতিটি মানুষের কাছে অর্থবহ করে তুলতে এক কদম অগ্রসর হওয়াও কখনো সম্ভব নয়। এ কথাটা বঙ্গবন্ধু নিজে অন্তর দিয়ে যে উপলব্ধি করেছিলেন তা তার ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে আজকের দিনে অনেক সত্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এ কথাও স্পষ্ট সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর সেই উপলব্ধির সঙ্গে ১৯৭৫ সালে সুর মিলাতে ব্যর্থ হয়েছিল এ জাতি, যেমনটি সক্ষম হয়েছিল ১৯৭১ সালে। হতাশাটা এখানেই। জাতি প্রস্তুত ছিল না। আবার বঙ্গবন্ধুর সামনেও এর কোনো বিকল্প ছিল না। তাই তিনি সব জেনে বুঝে ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্তব্য সম্পাদন করতে সক্ষম উপযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠনও ছিল না। এমনকি দল হিসেবে আওয়ামী লীগও প্রস্তুত ছিল না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র তিন বছর। এত অসহিষ্ণুতা, এত বিরোধিতা সেদিন আশা করেননি বঙ্গবন্ধু। তার শিষ্য, তার মানসপুত্র নামে পরিচিত বিশ^স্ত সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব, শাহজাহান সিরাজ সবাই অন্য দলে। তুখোড় বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী সংসদে বিরুদ্ধে বলে। তার ডানহাত তাজউদ্দীন আহমদও দূরের মানুষ। নানা কারণে তার সঙ্গে মনোমালিন্য অথবা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। আজকাল সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানও তেমন কাছে আসতে পারেন না। তখন সময়টা ছিল প্রিন্স কোট তথা জিন্নাহ কোট পরা মোশতাকের দখলে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার জন্য আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু চেষ্টা চালিয়েছেন নিঃসঙ্গ শেরপার মতোই। বাকশাল সম্পর্কে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে; কিন্তু এ কথা সত্যি যে, ইতিহাসের উল্লিখিত দাবি পূরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব প্রচেষ্টায় বাকশাল গঠন ব্যতীত বিকল্প কিছুই ছিল না। । ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা কমিশন যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন, তাতে সঠিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছিল। উৎপাদন শক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণ ও সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা তখনই বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেন। আমরা জানি, শিল্প-কৃষিসহ অর্থনৈতিক অন্যান্য ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে তোলা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো সমাধান করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য। তখনই প্রশ্ন এসে যায়, কোন পদ্ধতিতে এই অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হবে? পাকিস্তান আমলে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিগড়ে আবদ্ধ ছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমরা পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের কথা জানি। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, দেশের সব সম্পদের মালিক হলো জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের লোভ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্তে এই সম্পদের অপচয় করতে দেয়া হবে না। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল, সমাজতন্ত্র কায়েম করা। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি পাঠ করলে আমার এ বক্তব্যের সত্যতা মিলবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই ব্যবস্থায় দেশে সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক-শ্রমিক ও সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করা হবে। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের মে দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ভাষণে তিনি তাঁর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে মূল তিনটি শিল্পÑ পাটকল, সুতা ও সুতিবস্ত্র এবং চিনি শিল্পকে রাষ্ট্রীয়করণ করেন। কারণ তিনি জানতেন, প্রধান তিনটি শিল্পে ব্যক্তিমালিকানা রহিত করলে অর্থনীতির ওপর পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অপরদিকে ব্যাংক ও বিমা বহিঃবাণিজ্যের একটি বড় অংশকে জাতীয়করণ করে পুঁজি সৃষ্টির সহজপথগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিস্থাপন করেন। তাছাড়া পাকিস্তানি মালিকদের পরিত্যক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে যেগুলো বড়, সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়ে নেয়া হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত। জাতীয় স্বার্থে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রীয় খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এই খাতকে জাতীয় স্বার্থে সুষম শিল্পায়নের ভিত্তিরূপে গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত গড়তে বঙ্গবন্ধু মূলত শ্রমিক স্বার্থে শ্রমনীতি প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে শিল্প ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের নীতি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু মূর্খ এ জাতি জাতির জনকের এই গণমুখী শ্রমনীতির কিছুই বুঝল না, উপলব্ধিতে আনল না। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র স্বাধীনতার পর কৃষির ব্যাপারে বিশেষত মেহনতী কৃষকের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। স্বাধীনতার পর যে প্রশ্নটি জনজীবনকে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত করেছিল তা হলো ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। অবশ্য এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনেক কারণের একটি কারণ ছিল মুদ্রাস্ফীতি। এর সঙ্গে জড়িত ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এছাড়াও দুর্নীতিও দ্রব্যমূল্যকে প্রভাবিত করে। এসব বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বঙ্গবন্ধু কতগুলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাস্বরূপ ১০০ টাকার নোট বাতিল করেন। উক্ত নীতি অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সংকোচনের নীতি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে উল্লিখিত পদক্ষেপের ফলে মুনাফাখোর মজুতদার ও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধনীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য যেটুকু রাষ্ট্রীয় খাত গড়ে তোলা হয়েছিল তা কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধু সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সুসম্পন্ন করতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি তথা বাকশাল কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন করতে চেয়েছিলেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে বাংলাদেশের শোষিত, নির্যাতিত, শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে যে সফল সমাজ বিপ্লবের মানসে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি তথা বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, পরাশক্তিগুলো তাদের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে এই কর্মসূচিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে দেশীয় এজেন্টদের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। শুধু তা নয়, এ সম্পর্কে নানান সব কুৎসা রটানো শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত ক্ষোভ হিসেবেও তুলে ধরে। অর্থের বিনিময়ে আজো কাজটি অব্যাহত আছে। ষড়যন্ত্রীদের এই দুরভিসন্ধিকে উপলব্ধিতে এনে বর্তমান সময়েই বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি তথা বাকশাল কর্মসূচির মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন গণমানুষের স্বার্থে একান্ত জরুরি।

কুমার প্রীতীশ বল : কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App