×

মুক্তচিন্তা

তত্ত্বাবধানবিহীন শিক্ষাও অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২১, ১২:১০ এএম

নিউ কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর এবং শিক্ষা গবেষক ড. সুগাতা মিত্র তার ‘দেয়ালে গর্ত’ নামক গবেষণার দ্বারা দেখিয়েছেন যে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা সুপারভিশন না থাকলেও শিশুরা নিজেরাই কোনো বিষয় চমৎকারভাবে শিখতে পারে এবং অন্যকে শেখাতে পারে যদি তারা জানার আগ্রহ বা উৎসুক নামক প্রেষণার দ্বারা তাড়িত হয়। ১৯৯৯ সালে ড. মিত্র এবং তার সহকর্মীরা নয়াদিল্লিতে একটি বস্তি সংলগ্ন দেয়ালে গর্ত করে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি কম্পিউটার রেখে এসেছিলেন এবং ওই এলাকায় একটি গোপন ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলেন। তারা দেখলেন যে, বস্তির শিশুরা কম্পিউটারের চারদিকে খেলা করছে এবং কম্পিউটার চালানো শিখছে, ইন্টারনেটের ব্যবহার শিখছে এবং একে অপরকে শেখাচ্ছে। বাস্তবিকই তারা কোনো শিক্ষকের সহযোগিতা ছাড়াই এবং বিদ্যালয়ের চিরাচরিত পরিবেশের বাইরে থেকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মতো আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শিখে ফেলেছে। নতুন বিষয়ের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থেকে শিশুরা হাতেনাতে কম্পিউটারের ব্যবহার শিখেছে। শেখার আনন্দ, তাদের এক ধরনের নেতৃত্ব, ইচ্ছে, সুপিরিয়রিটি এবং মেন্টরিং মানসিকতার জন্ম দিয়েছে, যা তাদের পরিচালিত করেছে অন্যদের শিক্ষা দিতে। শিক্ষার জন্য এটি একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, এটি এক ধরনের উচ্চ স্তরের প্রেষণা। একজন শিক্ষকের এটি জানা একান্ত প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষা প্রমাণ করেছে এবং দেখিয়েছে যে, সরাসরি শিক্ষকের কোনো ইনপুট ছাড়াই একটি পরিবেশ যা জানার আগ্রহকে নাড়া দেয় এবং এই আগ্রহ বা নাড়া দেয়া স্বনিয়ন্ত্রিত বা আত্মপরিচালিত শিক্ষার মাধ্যমে এবং সহপাঠী বা একই বয়সিদের সঙ্গে জ্ঞান বিনিময় ও আলোচনার মাধ্যমে ঘটে থাকে, যা সাধারণ শ্রেণিকক্ষে সাধারণত ঘটে না। ড. মিত্র এটিকে ‘মিনিমাল্যি ইনভ্যাসিভ এডুকেশন’ বলে অভিহিত করেছেন। আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই এবং চিন্তা করি মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আমরা যা যা শিখেছি তার কী কী ধরে রাখতে পেরেছি? সেখানে যা যা শিখেছি তার সবই কি ধরে রাখতে পেরেছি? সবই কি দরকার ছিল? আমি যা জানতে চেয়েছিলাম তার উত্তর কি পেয়েছিলাম? এখন কি আমি যা জানতে চাই তা জানতে পারি? আমরা কথা বলা কীভাবে শিখেছি? কীভাবে আমরা কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেকটাই বলে দেয় আমাদের কীভাবে শিখতে হবে, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা কী হবে। আমার মনে আছে স্কুলজীবনে টেলিভিশনে এক দেশের খবর, ঘটনাবলি টেলিভিশনের পর্দায় কীভাবে দেখায় যেখানে বিভিন্ন দেশের অবস্থান বিভিন্ন উচ্চতায়। টিভি ক্যামেরায় কিছু ধরে নিয়ে এলে তা টিভির পর্দায় দেখানো যায় কিন্তু পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি কীভাবে লাইফ দেখায় এটি ছিল আমার উৎসুকের বিষয়। এই প্রশ্নের উত্তর আমি কোনো পাঠ্যবইয়ে পাইনি, স্কুলেও পাইনি। আমার বাবা আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীনের লেখা একটি বিজ্ঞানের বই পড়তে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে জেনেছিলাম যে, বঙ্গোপসাগরের ওপরে সাড়ে ৪৯ হাজার ফুট ওপরে ইনটেলসেট-৪ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করা আছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি প্রথম ওই উপগ্রহ সংগ্রহ করে এবং পরে ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে টিভিতে দেখানো হয়। অনেকটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলাম এই উত্তর পেয়ে। ড. সুগাতা মিত্রের পরীক্ষা আরো বলে দিচ্ছে যে, মানুষের ব্রেন হচ্ছে স্বসজ্জিত একটি পদ্ধতি এবং নতুন কিছু আবিষ্কার মানুষের স্বভাবতই ভালো লাগার বিষয়। ড. সুগাতা ১৯৮২ সাল থেকে তত্ত্বাবধানবিহীন শিক্ষা গবেষণা করার চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে ১৯৯৯ সালের ২৬ জানুয়ারি তার কিছু সহকর্মীর সহযোগিতায় ‘দেয়ালে গর্ত’ পদ্ধতি পরীক্ষাটি চালান, যেখানে তিনি দেখলেন যেসব শিশু নিজেরা কম্পিউটার চালু করছে, ইন্টারনেটে ঢুকছে এবং একে অপরকে শেখাচ্ছে যদিও কম্পিউটার সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কম্পিউটার চালু করার কোনো ধরনের নির্দেশনাও ছিল না দেয়ালের গর্তের কম্পিউটারে আশপাশে, শুধু কম্পিউটার স্থাপন করা ছিল। বিষয়টিকে তারা নিজেরাই শিখে নিয়েছে এবং অন্যদের শিখিয়েছে। শিশুরা বস্তি থেকে দলে দলে কম্পিউটার নামক অদ্ভুত বস্তুটির দিকে ছুটে আসতে থাকল। তারা অনুমান করে, নিজেদের প্রাকৃতিক বুদ্ধি খাটিয়ে, বিভিন্ন সুইস টিপে, এলোমেলো চাপাচাপি করে কম্পিউটার চালানো শিখে ফেলেছে। আমরা যদি ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে এই কথা চিন্তা করি, শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে ভাষা শেখার প্র্যাকটিস করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারি তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শিখে যাবে। কিন্তু আমরা ১২ বছর ধরে শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যপুস্তক ও সহকারী পুস্তক নিয়ে কত চেষ্টাই না করি কিন্তু শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শিখছে না, শিখছে দুয়েকটি গ্রামারের নিয়ম-কানুন যেগুলো তারা বাস্তবে ব্যবহার করতে পারছে না। বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করে ইংরেজি শিক্ষকের দেয়া হোমওয়ার্কের খাতা দেখে অবাক হলাম, এখনো তারা হোমওয়ার্ক দিচ্ছে এভাবে ‘টেনসের গঠন প্রণালি বাসা থেকে শিখে আসবে এবং খাতায় লিখে নিয়ে আসবে।’ প্রায় ছয় মাসের মধ্যে ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার চালানো, মাউসের ব্যবহার, কম্পিউটার কীভাবে খুলতে হয় এবং বন্ধ করতে হয়, অনলাইনে কীভাবে গেমস ডাইনলোড করতে হয়, মিউজিক ও ভিডিও কীভাবে ডাউনলোড করতে হয় শিখে ফেলেছে। শিশুদের যখনই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কীভাবে তারা এ বিষয়গুলো শিখল, তাদের উত্তর হচ্ছে তারা নিজেরা নিজেদের শিক্ষা দিয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টস এবং ক্রিয়াকে তারা ভিন্নভাবে নিজেরা নামকরণ করেছে, কারণ তারা তো মাউস, হার্ডডিস্ক, সফটওয়্যার এগুলো চিনে না। তারা তাদের ভাষায় ‘সুই’, ‘তীর’ ইত্যাদি নাম দিয়েছে। নয়াদিল্লির কালকাজির এই এক্সপেরিমেন্ট তারা পরে আরো দুটি লোকেশনে করেন। মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী সিটিতে এবং উত্তর প্রদেশের ম্যাডানটুসিতে এবং তারা একই ধরনের ফল পেয়েছেন। শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়া এ দুটি জায়গাতেও কম্পিউটার চালনা শিখেছে। তাদের শিক্ষা নেই, এমনকি ভাষাগত জ্ঞানও ছিল না অথচ কম্পিউটার ঠিকই শিখে ফেলেছ। এসব ছেলেমেয়ের মধ্যে কেউ কেউ স্কুলপড়ুয়া ছিল। তাদের শিক্ষক, মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করেছেন, যেসব ছেলেমেয়ে কম্পিউটার শিখে ফেলেছে স্কুলে তাদের উপস্থিতির হার বেড়ে গেছে এবং স্কুলের ইংরেজি পরীক্ষায় তারাই ভালো করছে। তাদের ভোকাবিউলারি বেড়ে গেছে, শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ বেড়েছে, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বেড়েছে, সহযোগিতার মনোভাব বেড়েছে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও বেড়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মসজ্জিত লার্নিং দ্রুত ঘটে এবং বেশিদিন স্থায়ী হয়। শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন তখন তিনি যদি শিক্ষার্থীদের স্তরে নেমে যেতে পারেন তাহলে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের ভীতি কমে যায়, শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করার সাহস অর্জন করে, ভুল করে করে শেখার যে ব্যাপারটি সেটি তারা আয়ত্ত করতে পারে অর্থাৎ তারা ন্যাচারাল পদ্ধতিতেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। শিক্ষার্থীরা যখনই দেখবে শিক্ষা আনন্দময়, শিক্ষা মানে মজা করা, শিক্ষা এক ধরনের খেলা তখনই তারা সেলফ-মোটিভেটেড হয়ে কোনো কিছু শিখতে আগ্রহী হবে এবং কোনো বিষয় কার্যকরীভাবে শিখে ফেলবে। আর যখনই শিক্ষার্থীদের জোরাজুরি বা চাপাচাপি করে শেখানো হয়, আনন্দ না দিয়ে শেখানো হয় তখনই শিক্ষা ব্যাপারটি তাদের নিকট কঠিন হয়ে ওঠে এবং প্রকৃত শিক্ষা সেখানে ঘটে না। কম্বোডিয়ায় শ্রেণিকক্ষে গণিতের একটি খেলা শিক্ষার্থীদের দেয়া হলো। দেখা গেল কেউই মজা করে তা করছে না। এ ক্ষেত্রে এই লেখক বলছিলেন ওটি রাস্তায় রেখে এলে এবং সব বয়স্ক লোককে সেখানে থেকে চলে যেতে বললে দেখা যাবে শিশুরা ঠিকই মজা করে খেলাটি খেলবে এবং খেলতে দেয়ার উদ্দেশ্যটিও সফল হবে।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App