×

মুক্তচিন্তা

সম্মোহনের সুযোগ নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ১১:৩৭ এএম

সম্মোহনের সুযোগ নেই

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।

করোনাকালে বর্তমানে বাংলাদেশের সনাতন সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ এক বিশেষ সময় পার করছে। ব্যাপক পরিবর্তনের পেছনে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার অপব্যবহার অপপ্রয়োগ অপচেষ্টার মাত্রাগত ওঠানামা যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় তেমনি যাবতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রাকে টেকসইকরণে মনোযোগে মনোমালিন্যের দৈন্য ও দুর্দশার সুরও শোনা যায়। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া কোনো উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সেই উন্নয়নকে টেকসইকরণের ভাবনা সংযুক্ত না থাকলে উন্নয়ন সম্পর্কে ভুল মেসেজ যেতে পারে সেই জনগণের কাছে, যাদের জন্য এই উন্নয়ন। এই উন্নয়ন যে কোনো পক্ষ-বিপক্ষের নয় সকলের এটি প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা না পেলে উন্নয়নের প্রতি সমর্থন আস্থা বা উন্নয়নের সুফল ভোগের আকাক্সক্ষা অভিপ্রায়ে ঘুণ ধরতে পারে। লাগসই প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াসকে অর্থবহ করে তোলে। কৃষি জমিতে ধান ফল ফসল উৎপাদনের চেয়ে সেখানে লোনা পানি তুলে পরিবেশ বিপন্ন করে মাছের চাষ করার লাগসই প্রযুক্তি আপাত আর্থিক লাভ ঘটায় বটে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের জন্য কতটা কার্যকর বা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত প্রয়াস তা পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা ওঠে আসে। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার তখনই তাৎপর্যবহ হবে যখন দেখা যাবে ন্যূনতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া, বর্জন ও অর্জনের মধ্যে দূরত্ব দৃশ্যগোচর হয়ে দেশজ সম্পদ ও সেবা উৎপাদন নিরাপত্তার সঙ্গে নির্ভরতার সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সময়ের কষ্টিপাথরে যা যাচাইযোগ্য হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে তা-ই টেকসই উন্নয়ন।

ষাটের দশকে এ দেশে ভূখণ্ডে সবুজ বিপ্লবের ধারণা আমদানি সূত্রে চলে আসে। তার সঙ্গে মার্কিন মুল্লুকের ইউক্যালিপটাস প্রকৃতির গাছেরাও চলে আসে এ দেশে। এ গাছ মাটির ভেতর থেকে সব রস এত তাড়াতাড়ি শোষণ করে যে পাশের আর সব গাছপালার জন্য আর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই, ফলে দেশীয় বনেদি বংশীয় বৃক্ষরাজির জীবনে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা উপস্থিত হয়। এটা বুঝতে প্রায় পাঁচ দশক সময় লেগে গেল। ইউক্যালিপটাসের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরিতে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেছে আরো বেশ কিছুটা সময়। তথাপি এখনো দেখা যায় এখানে-সেখানে সে লোকচক্ষুর আড়ালে অজ্ঞাতনামা আসামির মতো সে রয়ে গেছে। দেশীয় মাগুর ও কই মাছদের সংসার এখন দারুণ দুদর্শায়। তাদের বংশ রক্ষা এখন রীতিমতো কঠিন হয়ে দঁাঁড়িয়েছে। থাইল্যান্ডের অতি স্বাস্থ্যবান হাইব্রিড কই আর আফ্রিকার বেঢক সাইজের মাগুরের সঙ্গে স্বার্থ ও সৌন্দর্যের মোকাবিলায় তাদের জাতীয়তার আইডি কার্ড এখন বাতিল হওয়ার পথে। অর্থনৈতিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া দিন দিন কঠিন, কর্কশ ও কষ্টদায়ক হওয়ায় মানুষ এখন একসঙ্গে এক দাগে হঠাৎ করে বড় হওয়া কই-মাগুরের দিকে ঝুঁকছে, অথচ দেশজ সংস্কৃতি ও আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা দেশীয় কই-মাগুরের মান-মর্যাদার মর্তবা ও জেল্লাতির দিকে কারো নজর যেন আজ থেকেও নেই। দুর্নীতি যেমন সুনীতিকে বাজার থেকে ঝেটিয়ে-লাঠিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছে তেমন হাইব্রিড ভাব ভাবনারা অনুভবের হাটে-মাঠে-ঘাটে নানান ফন্দিফিকির এঁটে চলেছে। অনেকের অসাবধান অশালীন উচ্চারণে সামাজিক সৌহার্দের পরিবেশে পঙ্কিলতার প্রবেশ ঘটে চলছে।

সবুজ বিপ্লবের মতো কৃষি বিপ্লবের জয়-জয়কার সর্বত্র, এটা যথেষ্ট প্রয়োজনীয় ও যুক্তিযুক্ত বটে। কিন্তু দেখা দরকার এই কৃষি বিপ্লব পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রকৃত প্রস্তাবে কেমন প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা অতিমাত্রায় বেড়েছে পোকামাকড় দমনের নামে, অধিক ফসল উৎপাদনের আশায় অজৈব সারের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে অসম্ভব উপায়ে, অধিক সময় ধরে অপচনশীলতা নিশ্চিত করতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন, গরুকে মোটাতাজা করতে হরমোন পরিবর্তন এবং মাছের চাষে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের জন্য মাছকে খাওয়ানো হচ্ছে উচ্ছিষ্ট উদ্ভূত নানান ফিড। এখন এই কিটনাশক, এই সার, এই ফরমালিন, এই ফিড নানান উপায়ে অপ-উপসর্গ হয়ে মানবদেহে ঢুকছে এবং এর ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আপত্তিকর অগ্রহণযোগ্য অনেক কিছুই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বর্মকে করেছে পর্যুদস্ত। হাসপাতালগুলোতে জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগা রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক চাষাবাদ পদ্ধতিকে টপকিয়ে জমিজমার কৌলিন্য নষ্ট করে সহজে সস্তায় অধিক অর্থকরী মাছ চাষের আয়োজন অবারিত চলছে সেসব অঞ্চলে।

এ কথা ঠিক, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো ধীরগতি প্রকৃতির কৃষি (খাদ্যশস্য, মৎস্য, আমিষ, শর্করা) উৎপাদন ব্যবস্থা দিয়ে সম্ভব নয়। জমিতে আগে একটি ফসল (আমন ধান) ফলানো হতো, এখন তিন তিনটি ফসল ফলানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির উর্বরা শক্তি ঠিক রাখার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে উচ্চ ডোজের সার ও কীটনাশক। একদিকে বর্ধিত উৎপাদনের উপকারিতা, অন্যদিকে প্রক্রিয়াগত স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদনের মওকায় প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি, মানব ও জীবদেহে সংক্রমিত রোগব্যাধির প্রকোপ তার জন্য ব্যয় (বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ) বাড়ছে। উপকার এবং অপকারের সালতামামি সমন্বয় সাধন করে দেখা যায় উন্নয়নের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে সবাইকে। অথবা কোনো উন্নয়নই বিনা বাক্য ব্যয় কিংবা লেনদেনে হয় না।

নগরায়ন বাড়ছে। গ্রামের মানুষ শহরে জীবন ও জীবিকার টানে পাড়ি জমাচ্ছে। শহরে সেই মানুষের ঠাঁই দেয়ার সামর্থ্য নেই ফলে শহরের উপকণ্ঠ যে গ্রাম সেই গ্রাম শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে দ্রুত। গ্রামের টাটকা ফলফলারি, মাছ, দুধ, মাংস এখন শহরে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে শহরে চলে যাচ্ছে। গ্রামে মানুষ থাকছে না, শহরে গিয়ে গ্রামের সামগ্রীর চাহিদা সৃষ্টি করছে আর যারা যদিওবা গ্রামে থাকছে তারা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। তারা অধিক লাভের আশায় তাদের সনাতন চাষ পদ্ধতি ও সনাতন সব আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে অতি আধুনিক চাষবাস করে হাইব্রিড উন্নয়নের পথে পা বাড়াচ্ছে। স্ফীতকায় নগরের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে তাদের। আর গ্রামের মানুষ শহরে এসে বন্দিত্ব বরণ করছে সীমিত নাগরিক জীবনের বসবাসের কারণে। তাদের খেলার মাঠ নেই, সাঁতার কাটার পুকুর নেই, উদার উন্মুক্ত বাতাস সেবনের সুযোগ নেই। যন্ত্রের মতো নাগরিক জীবনে তাতে অভ্যস্ত হতে গিয়ে তাদের পারিবারিক ঐক্য, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি মমতা ও যোগাযোগ রক্ষা সামাজিক সখ্যতা সবই হারাতে হচ্ছে। একে কি জীবন বলে? প্রত্যেকের জীবন যার যার তার তার। গ্রামের জীবন আর শহরের জীবনের মধ্যে সমান্তরাল সাযুজ্য হারিয়ে এখন শহরে বড় হচ্ছে যে শিশু সে গ্রামকে আর জানতে পারছে না- টাটকা ফল-ফসলের পরিবর্তে জাঙ্ক ফুড, প্রক্রিয়াজাত ফুড গ্রহণ করতে করতে নগরায়নের সীমাবদ্ধ সময় ও পরিসরে তার জীবনকে ই-পদ্ধতি প্রক্রিয়ার ছকে বেঁধে ফেলছে। এক সময় সুযোগ পেলেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদেশে পাড়ি জমানোর তাগিদ ও প্রয়োজনীয়তা এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌযানে সমুদ্র পাড়ি দিতে হচ্ছে তাকে।

শিক্ষা মানুষকে চক্ষুষ্মান করে, শিক্ষায় মানুষের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে। শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে, তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তোলে। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, জাতীয় জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগেরও তাই কোনো বিকল্প নেই। তবে কেমন বিনিয়োগ, কতটা বিনিয়োগ, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ও উদযাপনের উপায় কী- এ বিষয়গুলো পর্যালোচনায় আনা বা আসার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

একটি বৃক্ষকে সত্যই সবল ও সুস্থ হয়ে বড় বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃত পরিচর্যা প্রয়োজন। এ সময়টা দেখভালের প্রয়োজনীয়তা এজন্য জরুরি ও আবশ্যক যে, এ পর্যায়ে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত হলে পরবর্তী পর্যায় তথা অপরাপর অংশে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে এবং একসময় গোটা গাছটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইদানীং পরীক্ষা ব্যবস্থাকে মূল্যায়নমুখী দেখার পরিবর্তে পাস বা গ্রেডনির্ভর ভাবা হচ্ছে আর পাসের হার বাড়ায় বিশেষ পরিতৃপ্তিবোধ দেখা যায়। মশহুর ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের অ্যানশিয়েন্ট মেরিনার যেমন সমুদ্রে চারদিকে থৈ থৈ করা অপানযোগ্য পানি দেখে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেননি (ডধঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ)। তেমনি লাখো-কোটি শিক্ষিতের মধ্যে উপযুক্ত চাকরি প্রার্থী মিলছে না। বাইরের শিক্ষিত লোক এসে চাকরির বাজার মাত করছে বেকারের ভারে ন্যুব্জ এই অর্থনীতিতে। উচ্চতর শিক্ষায়তনে ভর্তির দুয়ারে গিয়ে অপারগ অনেককেই ঠায় দাঁড়ানো দেখতে হচ্ছে।

শিক্ষা মূল্যবোধকে জাগ্রত করার কথা, মূল্যবোধ অবক্ষয়ের উপলক্ষ হওয়ার কথা নয়। শিক্ষার্থীর মনে ভালোমন্দ জ্ঞানের বিকাশ, দায়-দায়িত্ববোধ, স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার আচরণের উদগাতা ও উপলক্ষ, উপলব্ধি, পারঙ্গমতা তথা দক্ষতা ও যোগ্যতা সৃষ্টির জন্য যদি না হয় শিক্ষা, বরং শিক্ষা যদি হয় ঠিক বিপরীত সব অবস্থা ব্যবস্থা তার চেয়ে দুঃখজনক অবস্থা আর কী হতে পারে? প্রযুক্তি শিক্ষা উৎকর্ষ অর্জনের জন্য, প্রযুক্তিকে কাজে লগিয়ে নতুন পথে নতুন উদ্যমে সময় ও সামর্থ্যকে সাশ্রয়ী করে তুলে অধিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য। শিক্ষা ও প্রযুক্তি যদি অসৃজনশীল, অপচয় অপব্যয় অপঅভ্যাস গড়ে তোলার পথ পায় তাহলে তো সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App