×

জাতীয়

মাঠ প্রশাসনে অস্থিরতা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ০৮:৪৮ এএম

দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মাঠ প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ঘটনায় তা সামনে চলে আসে। সময়ের ব্যবধানে আবার তলিয়ে যায়। তবে এবারের ঘটনাটি রীতিমতো বিস্ফোরক। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, মাঠ প্রশাসনে এই অস্থিরতা কেন। এর নিরসনের উপায়ই বা কী? বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের মাঠ প্রশাসনে এই নাজুক পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। এর বীজও অনেক গভীরে প্রোথিত। মূলত দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে মাঠ প্রশাসনে। যার প্রতিফলন দেখা যায় ঘটনাচক্রে। এর জন্য মোটা দাগে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন অভিজ্ঞ মহল। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। ফলে সবস্তরের আমলারাই নিজেদের অধিক ক্ষমতাবান ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের আমলারা সেই ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে পারছেন না।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কর্মরত আমলাদের মধ্যে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির প্রভাব বহমান। ক্ষমতা পেয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের তেমন আমলে নিতে চান না তারা। তাছাড়া, সরকারও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনপ্রতিনিধিদের এড়িয়ে আমলাদের অগ্রাধিকার দেয়। এ কারণে কোনো কোনো কর্মকর্তা রাজনীতিকদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ায় আমলাতন্ত্র অধিকতর ক্ষমতা নিয়ে মাঠে নেমেছে। বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ে বিষয়টি প্রকটভাবে দৃশ্যমান।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রশাসনে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়মনীতি এবং সরকারি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যই মাঠ প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনার একেকটি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। তারা জনপ্রতিনিধিদের কাছে আর জবাবদিহিতা করেন না। আর এটিও সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামালপুরের সাবেক ডিসির নারী কেলেঙ্কারি, অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে বাগেরহাটের ডিসিকে বদলি, কুড়িগ্রামের ডিসির কাণ্ড, ফরিদপুরের ডিসি কর্তৃক স্থানীয় সাংসদকে হেয় প্রতিপন্ন করা, গৃহহীনদের ঘর নিয়ে কেলেঙ্কারি- এসব ঘটনায় সরকার এমনিতেই বিব্রত। সর্বশেষ ঘটনা বরিশালের ইউএনও’র সঙ্গে সিটি মেয়রের বিরোধ। সিটি মেয়র কি অন্যায় করেছেন তা পরের বিষয়, তদন্তে সত্য ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তবে এটা ঠিক, ওই ঘটনায় ইউএনও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেননি।

আমলাদের ক্ষমতা চর্চায় বিরক্ত ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারাও। একাধিক ঘটনায় তা প্রকাশ্যেও এসেছে। সম্প্রতি এর প্রতিফলন ঘটেছে খোদ জাতীয় সংসদে। গত ২৮ জুন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা ‘ম্লান’ হয়ে যাচ্ছেন বলে সংসদে উষ্মা প্রকাশ করেন। তোফায়েল বলেন, যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত।

জানতে চাইলে সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান ভোরের কাগজকে বলেন, বরিশালের ইউএনওর সঙ্গে সিটি মেয়রের বিরোধকে কেন্দ্র করে আমলাদের সংগঠন যে বিবৃতি দিয়েছে তা কোনোভাবেই পেশাদার সংগঠনের মতো হয়নি। এটা দলীয় বা কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র কিংবা অঙ্গ সংগঠনের বিবৃতির মতো হয়ে গেছে। এটার কারণও আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগেও আমলাদের সংগঠন ছিল। তখন যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংগঠনের পরিচয় রেখে আসতেন। আমলাতন্ত্রে ঢোকার পর তারা একটা বৃত্তের মধ্যে চলে যেতেন। ওই বৃত্তের মধ্যে থেকেই সংগঠনের নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু এখনকার যারা তারা কোনো বৃত্তের মধ্যে ঢুকতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের মতো চালাতে চান। এসব পরিচয় এখানে চলে আসায় সমস্যা বাড়ছে। সংকট শুধু এখানে নয়, আরো গভীরে উল্লেখ করে সাবেক এই সচিব বলেন, আগে রাজনীতিবিদরা জনসম্পৃক্ত হতেন। এখন আমলাসম্পৃক্ত হওয়ায় একটা সমস্যা হচ্ছে। আগে রাজনীতিবিদরা আমলাদের দূরে রাখলেও এখন সবাই আমলানির্ভর। এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এর আগে, বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে গত বুধবার রাতে শোক দিবসের ব্যানার খোলাকে কেন্দ্র করে ইউএনওর বাসভবনে হামলা হয়। এ সময় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর আনসার সদস্যদের গুলি ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। সংঘর্ষ হয় পুলিশের সঙ্গেও। এরপর বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত চলমান। এ রকম পরিস্থিতিতে পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে বরিশালের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন ঢাকায় বৈঠকে বসে এবং বৈঠক শেষে যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে বরিশালের মেয়র সম্পর্কে আপত্তিকর ও রূঢ় ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি বিচারের আগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ওই ঘটনার পর জনপ্রতিনিধি ও আমলারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, সংবিধানে কাজের যে গণ্ডি দেয়া আছে- সে অনুযায়ী এখতিয়ারের মধ্যে থেকেই সবাইকে যার যার দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার বরিশালে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনার সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

অন্যদিকে, ঘটনাটিকে ভুল বোঝাবুঝি বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। গতকাল সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি এখন বেশি মাত্রায় নেই, এটি সমাধানের দিকে চলে যাচ্ছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

কর্মকর্তাদের তথা আমলাদের সংগঠনের বিবৃতির ভাষাসহ সার্বিকভাবে কোনো সংকট আছে কিনা তা জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, অবশ্যই কোনো সংকট নেই। তবে এসোসিয়েশনের বিবৃতিটা ‘চটজলদি’ হয়েছে। বরিশালের ঘটনায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে কিনা- প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, না, আমি একেবারেই মনে করি না। মতপার্থক্য থাকতে পারে, এটা থাকবেই। পরিবারের ভেতরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমনি মতপার্থক্য থাকে, বাবা-সন্তানের মধ্যেও মতপার্থক্য থাকে। আমরা যারা কাজ করি, আমার অধীনস্থদের সঙ্গে আমার কথায় মতপার্থক্য থাকলেও আবার আমরা একসঙ্গে কাজও করি।

বিশ্লেষকদের মতে, ওই বিবৃতির পর সরকার দুরকম পদক্ষেপ নিয়ে এগুচ্ছে। যার একটি জনপ্রশাসন এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে। তথ্যমন্ত্রী ‘এসোসিয়েশনের বিবৃতিটা চটজলদি হয়েছে’ লাইনটি বলে বিবৃতির বিষয়ে সরকার যে খুশি নয় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ঘটনাটিকে হালকা করে দুই পক্ষকেই খুশি রাখতে চেয়েছেন। পাশাপাশি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও বলেছেন, এভাবে কড়া ভাষায় বিবৃতি না দিলেও হতো। এতে সরকারের সঙ্গে সংগঠনের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এবং এর প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। তবে অনেকেই মনে করেন, সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যেই আমলানির্ভরতা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আমলাদের সংগঠনটি যেমন ট্রেড ইউনিয়নের মতো নয় তেমনি তাদের বিবৃতিও ট্রেড ইউনিয়নের মতো কাম্য নয়। এমন বিবৃতি দেয়া তাদের সার্ভিস রুলেও নেই। কারণ তাদের চাকরির চরিত্র আলাদা। তার মতে, সিভিল সার্ভিসে চাকরি করে কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হলে বিদ্যমান আইনেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে বিবৃতি দেয়া ঠিক নয়।

এছাড়া কেন্দ্রীয় কিংবা মাঠ প্রশাসনে কাজ করতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি বা নানা দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে সংবিধিবদ্ধ অবস্থায়ই প্রতিকার চাইতে হবে বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App