×

সারাদেশ

চরফ্যাশনে ফিসিংবোট নির্মাণে ডক ইয়ার্ড শিল্পের সম্ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫২ পিএম

চরফ্যাশনে ফিসিংবোট নির্মাণে ডক ইয়ার্ড শিল্পের সম্ভাবনা

চরফ্যাশনে ফিসিংবোট

চরফ্যাশনে ফিসিংবোট নির্মাণে ডক ইয়ার্ড শিল্পের সম্ভাবনা
চরফ্যাশনে ফিসিংবোট নির্মাণে ডক ইয়ার্ড শিল্পের সম্ভাবনা

নতুন মৎস্য ট্রলার তৈরি ও পুরাতন ট্রলার মেরামতে ডক ইয়ার্ড গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে ভোলার চরফ্যাশনে। একটি ডক ইয়ার্ড শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরিতে মোটা অঙ্কের অর্থলগ্নীর প্রয়োজন হলেও পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর টাকা আয়ের সম্ভাবনাও। আর এ ডক ইয়ার্ডে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মৎস্য ট্রলার মেরামতের পাশাপাশি নতুন ট্রলার তৈরি করেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পাড়ে উদ্যোক্তাগণ।

ভোলার বৃহৎ মৎস্যঘাট চরফ্যাশন উপজেলার মাদ্রাজ ইউনিয়নের সামরাজে অবস্থিত। এ সামরাজ মৎস্যঘাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ২হাজার মৎস্য ট্রলার ও নৌকা নদী ও সাগরে আসা যাওয়া করে। ভোলার ইলিশা, বোরহান উদ্দিন, দৌলতখান, তজুমদ্দিন, লালমোহন,মনপুরা, নোয়াখালির লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া,বরিশালের পটুয়াখালি, কলাপাড়া, কুয়াকাটা ও চট্টগ্রামের একাধীক মৎস্য ঘাটসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলের জেলেরা শত,শত মৎস্য ট্রলার নিয়ে চরফ্যাশনের মেঘনা,তেুতুলিয়া ও সাগর মোহনায় মৎস্য শিকারে আসে। এসব জেলেরা মাছ বিক্রয়ের জন্য প্রতিদিন সামরাজ মৎস্যঘাটসহ ঘোষেরহাট, পাঁচকপাট, আটকপাট,কুকরি-মুকরি ও ঢালচরের পাইকারি আড়ৎগুলোতে ভিড় জমান।

এ মৎস্যঘাটে বাঁধা থাকে শত, শত ট্রলার ও নৌকা। আর এসব ট্রলার ও নৌকা দিয়ে জেলেরা প্রতিদিন মৎস্য শিকার করে আমাদের মাছের চাহিদা যোগান দিচ্ছে। এসব ট্রলার ও নৌকাগুলো তৈরি ও মেরামতে প্রয়োজন ডক ইয়ার্ড। তবে পৌরসভাসহ ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বৃহৎ এ উপজেলায় যান্ত্রিক এবং অযান্ত্রিক প্রায় ১২হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রগামী সাত হাজার ট্রলার রয়েছে। তবে এসব ট্রলার ও নৌকা মেরামত এবং নতুনভাবে নৌকা ট্রলার তৈরি করার জন্য নেই পর্যাপ্ত ডক ইয়ার্ড।

জানা যায় পাঁচকপাট মৎস্যঘাট ,আট কপাট মৎস্যঘাট ও নুরাবাদ গাছিরখাল, নুরাবাদ হাজিরহাট রাস্তার মাথা ও মাদ্রাজের সামরাজ মৎস্যঘাটে মোট পাঁচটি ডক ইয়ার্ড রয়েছে। এসব ডক ইয়ার্ডগুলোর যায়গা সংকুলান বা অল্প কয়েকটি লেন থাকায় নতুন ট্রলার তৈরী ও মেরামতে জেলেদের অপেক্ষা করতে হয় দির্ঘ সময়। ফলে মেরামত যোগ্য ট্রলার বা নৌকা নিয়ে নদী ও সাগরে মৎস্য শিকারে যেতে অনেক বেগ পেতে হয় জেলেদের।

সরেজমিনে দেখা যায় সামরাজ মৎস্যঘাট ডক ইয়ার্ডে ট্রলার মেরামতে দিনরাত কাজ করছে অর্ধশতাধীক কারিগর। এ ডক ইয়ার্ডের চারটি লেনে তিনজন ঠিকাদার দ্বারা প্রতিটি ট্রলার মেরামতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে প্রডাকশনে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ঠিকাদার মামুন সেরাং বলেন, প্রতিটি ট্রলার মেরামতে ছোটবড় মিলিয়ে ৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঠিকা নেয়া হয়। তবে ডক ইয়ার্ড ভাড়া বাবদ একটি ট্রলার বা নৌকার জন্য প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে মাঝারি সাত হাজার ও বড় ট্রলার ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় ডক মালিককে।

এ ডকে রয়েছে কাকিন মিস্ত্রি যাকে আঞ্চলীকভাবে গাইনি বলে। যার কাজ হচ্ছে বোটের বাইনে (কাঠের জোড়া) তুলা/সুতার সলতে ঢুকানো। যাতে করে ট্রলার বা নৌকায় পানি প্রবেশ করতে না পাড়ে। আর বুশ মিস্ত্রির কাজ হচ্ছে মেশিনের সঙ্গে পাখা সেটিং করা। এছাড়াও লাইন, কাঠ ফিটিং, ওয়েল্ডিং, আলকাতরা, পুটিং ও মারামতের জন্যেও (মেরামত নয়) রয়েছে ভিন্ন কারিগর।

চরফ্যাশনের নদী ও সাগর উপকূল এবং নদী মোহনাসহ গভীর সমুদ্রে ইলিশের সিজন চললেও একরকম ইলিশ শূণ্য রয়েছে উপজেলার মৎস্যঘাটগুলোতে। জেলেরা বলছেন আগের তুলনায় চলতি বছরে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে দির্ঘদিনের অবরোধে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় বর্তমানে ইলিশের সাইজ বেশ বড় এবং ওজনও দেড় থেকে ২ কেজির কাছাকাছি। আগে ছোট বড় ট্রলারে লাখ লাখ টাকার ইলিশ পাওয়া গেলেও এবছর তেমন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা। আর তাই অনেক ট্রলার মৎস্যঘাটে অবস্থানকালে জাল ও ইঞ্জিনের পাশাপাশি ট্রলার মেরামতের কাজ করে থাকেন।

এ অঞ্চলের সমুদ্রগামী ট্রলারগুলো দৈর্ঘে ৪০ থেকে ৬০ ফুট ও প্রস্থে ১৪ তেকে ১৫ ফুট হয়ে থাকে। ডক ইয়ার্ড স্বল্পতা ও পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায় এসব বড় ও মাঝারি ট্রলার বা নৌকা নদী ও খালপাড়ের পরিত্যাক্ত যায়গাতেই বেশিরভাগ সময় মেরামতসহ নতুনভাবেও বানানো হয়ে থাকে। পাঁচকপাট স্লুইসঘাট এলাকার আবু কালাম মিস্ত্রি বলেন, একটি নতুন বড় ট্রলারের বডি তৈরী করতে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার মজুরি চুক্তিতে বানানো হয়। প্রথমে ট্রলারের কাঠামো তৈরী ও গলুই,চান্দিনা,কেবিন বা ছই,রান্নাঘর ও টয়লেট ইত্যাদি সুন্দর নকশা দ্বারা তৈরী করা হয়। সামরাজের কাকিন মিস্ত্রি সবুজ বলেন,আমরা নতুন ট্রলারের গাইনি,পুটিং,মারামত ও বুশ ফিটিং করতে প্রায় দেড় লাখ টাকা মজুরি চুক্তিতে করে থাকি। মিস্ত্রি সোহাগ বলেন, আমরা ডক ইয়ার্ডে নতুন বা পুরাতন ট্রলারগুলোর কাঠের প্রতিটি জোড়ায় সুক্ষ্মভাবে তুলা বা সুতার সলতে ঢুকানোর পরে কেরোসিন ও ধূপ আর পানির আঠালো মিশ্রণে সলতের ওপর পুটিং দেই। আবদুর রব বলেন, ট্রলারগুলোর তলা বা নিচের অংশে আলকাতরা দিয়ে মারামত শেষে কাদামাটির প্রলেপ দেই। সর্বশেষ কাদামাটি শুকিয়ে গেলে কিছুক্ষণ আগুনে পুড়িয়ে আলকাতরাকে ট্রলারের নিচের অংশের কাঠের সঙ্গে মজবুত করে দেই। মারামত শেষে ট্রলারের পিছনে বুশ মিস্ত্রি ইঞ্জিনের সেপে পাখা সেটিং করে দেন।

একজন ট্রলার মালিক জানান, ইঞ্জিন, জেনারেটর ও জাল-দড়িসহ একটি ট্রলার তৈরী করতে ৫০লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। তিনি জানান চাম্বল,গর্জন,মেহগনি ও ত্রিশূল জাতের কাঠ দিয়ে বেশিরভাগ ট্রলার বানানো হয়ে থাকে। সামরাজ ডক ইয়ার্ডের সহকারী পরিচালক নুর মোহাম্মদ বলেন, বছরের যে সময়গুলোতে ইলিশ থাকেনা এবং ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে সেই সময়টাতেই আমাদের ডক ইয়ার্ডে কাজের চাপ বেশি থাকে। এসময় বেশিরভাগ বোট মালিক তাঁদের বোটগুলোর মেরামত করান। এছাড়াও অনেকে নতুন ট্রলার ও নৌকা তৈরী করেন। তিনি আরও বলেন,আমাদের ডক ইয়ার্ডটি চারবছর আগে চালু করা হয়েছে। আমাদের বছরে পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হলেও প্রায় ২০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার বলেন, এ অঞ্চলের নদী ও সমুদ্র উপকূলে ইলিশের বিচরণ বেশি থাকায় এটি একটি ইলিশ নির্ভর উপজেলা। এখানে ইলিশকে কেন্দ্র করে কোটি, কোটি টাকার মৎস্য বানিজ্য হচ্ছে। আর তাই শিল্প নির্ভযোগ্য এলাকা হিসেবে চরফ্যাশনে আরও একাধীক ডক ইয়ার্ড শিল্প গড়ে তোলার ব্যপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App