×

জাতীয়

কেপিসি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিস্ময়কর বাংলাদেশি উদ্যোক্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ১০:৪১ পিএম

কেপিসি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিস্ময়কর বাংলাদেশি উদ্যোক্তা

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বিস্ময়কর বাংলাদেশি উদ্যোক্তা কালী প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত । ছবি: ভোরের কাগজ

শহরের নাম করোনা। নামটা শুনলে অনেকে হয়তো আঁতকে উঠতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে এই শহর। এই শহরের একটি এলাকার নাম কেপিসি পার্কওয়ে। কেপিসি মানে কালী প্রদীপ চৌধুরী। এই এলাকার অধিকাংশ ভবনই কেপিসি গ্রুপের অফিস। মূলত, বাংলাদেশের সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ গ্রামের এক জমিদার পরিবারের সন্তান এই কালী প্রদীপ চৌধুরী। পিতা কালীপ্রসন্ন দত্ত চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ আমলেই জমিদার। ঢাকা দক্ষিণ গ্রামের নামটি শুনে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন; কিন্তু এই গ্রামের নাম এটিই। এর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার কোনো সম্পর্ক নেই। পেশায় অর্থোপেডিক সার্জন হলেও মূলত তার পরিচয় এখন একজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী হিসেবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় হাজার হাজার একর জমি কিনে নগরের পর নগর গড়ে তুলেছেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে তার ব্যবসা এখন সুদূর যুক্তরাজ্য, ভারত ও আরব আমিরাতসহ পৃথিবীর আটটি দেশে। এসব দেশে রয়েছে ২৫ ধরনের ব্যবসা। মার্কিন প্রশাসনে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি এতই অপরিসীম যে পুরো একটি রাস্তার নাম করা হয়েছে তার মায়ের নামে। রাস্তাটির নাম শোভা ওয়ে। তার মায়ের নাম শোভা দত্ত চৌধুরী। পারিবারিকভাবে তাদের টাইটেল দত্ত, চৌধুরী তাদের উপাধি। টাইটেল দত্ত ছাপিয়ে উপাধি চৌধুরীই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।

মার্কিন অর্থনীতি বিভাগের হিসেবে কেপিসি গ্রুপের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশের এই জমিদার নন্দন ষাটের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন মাত্র ৮ ডলার হাতে নিয়ে। তার পরিবার চায়নি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রে তার উত্থানের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। চিকিৎসা শিক্ষায় তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন, এমডি করেছেন অর্থোপেডিক সার্জন হিসেবে। কাজও শুরু করেছিলেন একজন ডাক্তার হিসেবে। চিকিৎসক হিসেবে এতটা সুনাম অর্জন করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তার চিকিৎসা নিতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসতেন। এই চিকিৎসা সেবা থেকে তিনি শুরু করেন হেলথকেয়ার ফেসিলিটি। সেখান থেকে তার উত্থানের গতিপথ বদলে যায় নানা দিকে। এখন তিনি নানা বিষয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা। নির্মাণ করেছেন হেলথকেয়ার সেন্টার, পাঁচ তারকা হোটেল, বাণিজ্য নগর, মেডিকেল কলেজসহ নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ওয়াইনারি ও চা বাগান। শুধু ভারতেই রয়েছে তার ১৬টি চা বাগান। ইউক্রেনে আছে তার নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট, দুবাইয়ে আছে সাত তারকা হোটেল। ক্যালিফোর্নিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে নির্মাণ করেছেন অসংখ্য নগর। যুক্তরাজ্যে বাকিংহাম প্যালেসের সামনে নির্মাণ করছেন একটি পুরো গ্রিন টাউন। ভারতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তার ১৬টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, রয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। সম্প্রতি লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে দুটি হাসপাতাল কিনে আবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। ব্যবস্থাপনার অভাবে হাসপাতালগুলো চালাতে পারছিল না কর্তৃপক্ষ। এই হাসপাতাল দুটি কেপিসির হাতে পড়ায় খুশি নগর প্রশাসন। কারণ তার জাদুকরী ব্যবস্থাপনায় নতুন করে গড়ে উঠবে আবার এই হাসপাতাল দুটি। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে এই রাজ্যে। নানা কারণে যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালাতে পারছে না, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিনে তিনি নিয়ে গেছেন সফলতায়। ক্যালিফোর্নিয়াতে তার সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা বাড়ি, যেখানে নিয়মিত অতিথি ওবামা থেকে জর্জ বুশ পর্যন্ত। এমনকি রোনাল্ড রিগান ও বিল ক্লিনটন নিয়মিত যেতেন তার সঙ্গে ডিনার করতে। মার্কিন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।

গত সপ্তাহে এক মধ্য দুপুরে কালী প্রদীপ চৌধুরী অর্থাৎ কেপিসির সঙ্গে কথা হয় তার ক্যালিফোর্নিয়ার করোনা শহরের অফিসে। সঙ্গে ছিলেন দুবাইয়ে বাংলাদেশের আরেক উল্লেখযোগ্য শিল্প উদ্যোক্তা আল হারামাইন গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান ও জাপানে বাংলাদেশের এক শিল্পোদ্যোক্তা কাজী সারোয়ার হাবিব। তার নিজস্ব অফিস ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন মনে হচ্ছিল তিনি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। অথচ সেদিনই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আলাপের শুরুতেই স্মৃতিচারণ করলেন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাতের একটি গল্প দিয়ে। ষাটের দশকের শেষের দিকে কোনো একটি জায়গায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ খ্যাত এই সাহিত্যিকের। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কালী প্রদীপ চৌধুরীকে বলেছিলেন, কখনো নিজেকে নিজের যে জায়গা- সেখান থেকে ছোট ভাববে না অথবা বড়ও ভাবতে চাইবে না। তুমি যে জায়গাতে আছো সেটি তোমার জন্য নির্ধারিত। তাহলে জীবনের চলার পথটি মসৃণ হয়ে যায়।

২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতের আহ্বানে দেশে বিনিয়োগ করতে আসা এই বাংলাদেশি-আমেরিকান তার হতাশার কথা জানালেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজধানীর পূর্বাচলে ১৪২ তলা একটি টাওয়ার নির্মাণ করতে, যেখানে থাকবে উন্নত মানের হোটেল অফিস ও আরো অন্যান্য সুবিধা। সিলেটের গোলাপগঞ্জে তার জন্মস্থান ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একটি মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়। প্রথম বাধা এসেছে স্থানীয় পর্যায় থেকে। রাজধানীর পূর্বাচলে তাকে যে জায়গা বরাদ্দ দেয়ার কথা ছিল, সেটা দেয়া হলো অন্য একটি শিল্প গ্রুপকে। যে শিল্প গ্রুপের পক্ষে কখনোই এই ভবনটি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে তার কিছু কথোপকথনের কথা উল্লেখ করলেন, যা এখানে উল্লেখ না করাই ভালো। খুব বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। কারণ তিনি বললেন, এতে নিজের দেশেরই বদনাম হয়। তবে তিনি হাল ছাড়েননি; দেশে এখনো কিছু করার আশায় আছেন। অর্থমন্ত্রীর পর তার ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন তাকে আশ্বাস দিয়েছেন সর্বাত্মক সহযোগিতা করার। সিলেট অঞ্চলে একটি মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় করার উদ্যোগটি এখনো অব্যাহত আছে। রাজধানীর আশপাশে করতে চান একটি উন্নতমানের নার্সিং ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি কিছুটা অবদান রাখতে চান। গড়তে চান আধুনিক নগর; কিন্তু তার জন্য তো লাগবে সরকারের সহযোগিতা। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারের ভিতরে নানা সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক শক্তি ও আমলাতন্ত্রের যে ভ‚ত রয়ে গেছে, সেটিকে তিনি প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করেন। মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান প্রস্তাব দিলেন সিলেট এমসি কলেজের পেছনে তার বিশাল একটি জায়গা রয়েছে, সে জায়গায় কিছু একটা করতে। কেপিসি সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।

আলাপে আলাপে ইতোমধ্যে কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আমাদের আতিথেয়তার জন্য তার কয়েকজন কর্মচারীকে সেদিন অফিসে থাকতে হয়েছে। ছুটির দিনে কাজ করার জন্য তাদের এমন ভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল তাদের ছুটির দিনটা মাটি করার জন্য তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন। গল্প করতে করতে ভাবছিলাম তার পড়াশোনার কথা। ব্যবসা-বাণিজ্য তার কাজ হলেও সাহিত্য নিয়ে তার পড়াশোনা দেখলাম অপরিসীম। মার্কিন সমাজ ও অর্থনীতির নানাদিক তার নখদর্পণে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তার হালনাগাদ সব তথ্য আছে। রাস্তায় এসে গাড়িতে তুলে দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি আপনার সম্পর্কে জানি। ‘বি কেয়ারফুল, সাম টাইম ইউ আর এহেড অফ ইউর টাইম’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সফল বিজনেস টাইকুন শেষ বেলায় আমাকে কি বলতে চাইলেন তা ভাবতে ভাবতে রওনা দিলাম লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের দিকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App