×

মুক্তচিন্তা

আমানতের সুদহার নির্ধারণে ব্যাংক মুনাফায় চাপ বাড়তে পারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২১, ১১:৪০ এএম

করোনা মহামারি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস, বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন; দারিদ্র্য বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। বলতে গেলে জীবন-জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকেরই অবনমন ঘটেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা গত দুই দশকের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। দেশের আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

গত বছর এপ্রিল মাস থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার এক অঙ্কে অর্থাৎ ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তবে ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ সুদহার ২০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা একই সঙ্গে অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব একসঙ্গে শুরু হয়েছে। ফলে বিনিয়োগের জায়গাগুলো ক্রমেই সংকোচিত হয়ে পড়ছে। ঋণের চাহিদা না থাকায় অনেক ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অনেক ব্যাংক গৃহনির্মাণের মতো দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ ৮ শতাংশের মধ্যে কার্যকর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো ভালো গ্রাহক পাচ্ছে না। গত ২০-২৫ বছর ধরে সুনাম-সুখ্যাতির সঙ্গে ব্যবসা করছেন এমন ব্যবসায়ীও ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকরির বাজার খারাপ থাকায় ক্রেডিট কার্ডেও সাড়া মিলছে না। করোনায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার জায়গা নেই বলেই চলে। এর সঙ্গে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার টাকা যুক্ত হয়েছে ব্যাংকে। প্রণোদনার টাকা ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে পারছেন না। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত উৎসবভিত্তিক অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে মার খেয়েছে। ফলে টাকা ঘুরছে না, পুনরায় চলে যাচ্ছে ব্যাংকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ যে তলানিতে চলে গেছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই বোঝা যায়। চলতি বছরের ৩১ মার্চ (বার্ষিক ভিত্তিতে) পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত আমানতে সবচেয়ে বেশি ২২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। যদিও আমানতের এ উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে এ ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ১ শতাংশের বেশি হয়নি।

আমানতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলোও। যদিও এসব ব্যাংকের ঋণে প্রবৃদ্ধির বদলে উল্টো সংকোচন হয়েছে। তথ্য অনুয়ায়ী, মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিদেশি ব্যাংকগুলোর আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে এ শ্রেণির ব্যাংকগুলোর ঋণ সংকুচিত হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১১ দশমিক ৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধির এ অসামঞ্জস্যতাই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের স্তূপ তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ঋণ আমানতের অনুপাতন জুন শেষে নেমে এসেছে ৭২ শতাংশ। যেখানে সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে ৮৭ শতাংশ। ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত অর্থ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর হাতে একদিকে উদ্বৃত্ত তহবিল বাড়তে থাকে, অপরদিকে বিনিয়োগ চাহিদা কমতে থাকে। সব মিলে আবারো তহবিল ব্যবস্থাপনায় চাপে পড়তে হচ্ছে। এ চাপ সামাল দেয়ার জন্য আমানতের সুদহার কমাতে থাকে। এক পর্যায়ে গড় সুদহার ৪ শতাংশে নেমে আসে। ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেকখানিই সমন্বয় হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়। এখন থেকে ব্যাংকের তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদহার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। গত জুন মাসে ভোক্তা মূল্যসূচকের হিসাবে গড় মূল্যস্ফীতির ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সে হিসাবে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংককে মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আমানতের সুদের সঙ্গে ব্যাংকের অপারেশনাল খরচ যোগ করলে এ হার দাঁড়াবে সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশের মতো।

করোনার কারণে গত প্রায় দুই বছর ধরে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে গেছে। বেশিরভাগ ঋণগ্রহীতাই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার নিয়মিতরাও ইচ্ছাকৃতভাবে অনিয়মিত হওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই এখন মন্দ মানের। ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করছে সে আয়ের সিংহভাগ আসে ঋণের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদ থেকে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ বলতে গেলে বাকিতে হিসাব করছে, অনেকে এ ধরনের সুদের আয়কে বলছেন ‘কাগুজে আয়’। কারণ গত বছর থেকে শুরু করে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করলেও গ্রহীতা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এ সময়ের মধ্যে ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর কোনো রকম দণ্ড, সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ মে ঋণখেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয় সরকার। সরকারের দেয়া ‘বিশেষ’ ওই সুবিধার আওতায় গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলো নবায়ন করে। বিশেষ ছাড়ের কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদদের ভাষায় এ ধরনের মুনাফার বড় অংশই বলতে গেলে ‘কাগুজে’। কারণ এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি খেলাপি ঋণের আদায় অনেকটা অনিশ্চিত। ব্যাংকের আয় হচ্ছে অনিশ্চিত বিনিয়োগের ওপর অথচ প্রত্যেকটা খরচ হচ্ছে নগদ বা প্রকৃত। যেমন আমানতের সুদ, অপারেটিং খরচ, মুনাফার বিপরীতে সরকারকে প্রদত্ত কর, শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ট ইত্যাদি সবই নগদে পরিশোধ করতে হচ্ছে। মহামারির আগে দেশে ব্যাংকগুলোর গড় খেলাপি ঋণ ছিল ১০ শতাংশের মতো, আর অল্প কয়েকটি ব্যাংকের ৬০ শতাংশের মতো ছিল। ব্যাংকাররা বলছেন, নীতি সহায়তা চলমান থাকায় বর্তমানে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বুঝা যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, নীতি সহায়তার হিসাব বাদ দিয়ে সঠিকভাবে হিসাব করলে অনেক ভালো ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০-৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর আগে থেকেই যেসব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ তাদের বর্তমান অবস্থা কী তা বলাই বাহুল্য। আবার করোনার প্রভাবে বেশ কিছু ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন তথা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি কমপক্ষে ১১টি ব্যাংককে প্রভিশন সংরক্ষণে ১০ বছর পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ ছাড়া মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকাররা বলছেন বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক।

এ অবস্থায় আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া ব্যাংকারদের মারাত্মক চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। ব্যাংকারদের মতে, এমনিতেই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়ার ফলে আমানতের সুদহার কমিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ওপরে আমানতের সুদহার বেঁধে দিতে হলে কমপক্ষে সাড়ে ৫ শতাংশের ওপরে নির্ধারণ করতে হবে। একদিকে অলস অর্থ, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের আধিক্য, সঙ্গে ঋণের কম সুদহার সব মিলেই ব্যাংকগুলোকে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় সমন্বয় করতে হিমশিম খেতে হবে এবং অনেক ব্যাংক মুনাফা করতে পারবে না, যা মূলধনের ওপর চাপ পড়বে।

আমানতের অতিরিক্ত সুদ প্রদানের মাধ্যমে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বাড়লে আয় সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন মেয়াদি আমানত গ্রহণে নিরুৎসাহিত হতে পারে অন্যদিকে ঋণ ও অন্যান্য সেবার বিপরীতে সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অন্যান্য পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত, আমানতের সুদহার বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত, তাহলে ব্যাংকগুলো বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তহবিল ব্যবস্থাপনা করবে। দ্বিতীয়ত, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের বিষয়টি মাথায় রেখে বিকল্প পন্থাও নেয়া যেতে পারে। করোনাকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি, প্রণোদনা ও সহায়তা দিয়ে আসছে। জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস হিসাবে আমানতকারী জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে উচ্চ হারে সুদ দেওয়া যেতে পারে, যার একটি অংশ সরকার ভর্তুকি দিতে পারে। যেমন ৮ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে ৪ শতাংশ ব্যাংক আর বাকি ৪ শতাংশ সরকার দিতে পারে। সরকার এ ধরনের ভর্তুকি সহায়তা বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং সরকারি কর্মকর্তাদের গৃহনির্মাণ ঋণের বিপরীতে দিয়ে আসছে। করোনাকালে এ ধরনের আর্থিক সহায়তা বিশেষ শ্রেণির আমানতকারীদের জীবন মান উন্নয়নে সহায়ক হবে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোও স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে। এম. এ. মাসুম : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App