×

সারাদেশ

জনপ্রতিনিধি-আমলা মুখোমুখি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৪০ এএম

বরিশালের ঘটনায় উভয় কূলই রক্ষা করতে চায় সরকার। সমঝোতার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে চায়। এক্ষেত্রে কৌশলী পথে হাঁটছে ক্ষমতাসীনরা। চটজলদি আমলাদের বিরুদ্ধে যেমন কোনো অ্যাকশনে যাবে না, তেমনি দলের ক্ষতি হোক এমন কোনো ব্যবস্থাও নেবে না তারা। আপাতত ঘটনার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি জানিয়েছেন, আমলাদের নাখোশ করতে বা চটাতে চায় না সরকার। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে আমলাদের হাতে রাখতে চায়। অন্যদিকে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হোক, দলের কোনো ক্ষতি হোক তাও কাম্য নয়। জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক সম্পর্ক বহাল রাখতে জোর তৎপরতা চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, জনপ্রতিনিধি বনাম আমলাতন্ত্র এখন অনেকটাই মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় অনেকবারই তা দৃশ্যমান হয়েছে। সর্বশেষ দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের সাইডলাইনে রেখে আমলাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। সরকারের আসকারা পেয়ে আমলারাও অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তাদের কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের অবজ্ঞা বা এড়িয়ে চলার নীতি বেছে নেন। ফলে সারাদেশেই জনপ্রতিনিধি-আমলা দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠে। যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটেছে বরিশালে। এবার টনক নড়েছে সরকারেরও।

সূত্র মতে, আমলাতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বে বিব্রত সরকার। প্রায়ই বিব্রতকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য দুই কূল রক্ষা করেই সমঝোতার দিকে ঝুঁকছে সরকার। আমলা-জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের লাগাম টেনে ধরতে দুই পক্ষকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ভোরের কাগজকে বলেন, জনগণের কল্যাণের আলোকেই কর্মসূচি নেন জনপ্রতিনিধিরা। দেশের উন্নয়নে এসব কর্মসূচির বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমলাদের। দেশের উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন, তেমনি আমলারাও অপরিহার্য। স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কখনো কখনো বিচ্যুতি ঘটতে পারে। এসব ঘটনা যেন আর না ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে প্রশাসনের এমন ভাষায় বিবৃতি দেয়াও সঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি।

অপরাধীকে ছাড় নয়: কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেবে না সরকার এমন কঠোর মনোভাব সরকারের কর্তাব্যক্তিদের। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে অন্যরা যেন অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হয় সেজন্য সচেষ্ট সরকার। বরিশালে হামলার ঘটনায় যারাই জড়িত থাক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বরিশালের এই ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। নিজ দলের হলেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে যারা যারা জড়িত, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বরিশালের ঘটনাকে পুঁজি করে কাউকে পানি ঘোলা করতে দেওয়া হবে না। তদন্তে সত্য উদঘাটিত হওয়ার আগে এনিয়ে অতিমাত্রায় কথা বলা বা কিছু করাও সমীচীন হবে না। ঘটনাটি অনভিপ্রেত ও অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের দলের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। আমাদের দলের কেউ কোনো অপকর্ম করলে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।

তবে বিষয়টি মিটমাট হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ওই ঘটনায় মেয়র বরখাস্ত হতে পারেন কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বরিশাল নগরীতে পোস্টার অপসারণ নিয়ে সেখানে ইউএনওর সঙ্গে মেয়রের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এখন ইউএনও এবং থানার পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে। এমনও হতে পারে তারা মামলা প্রত্যাহারও করতে পারেন। বিষয়টি দুজনের মধ্যে মিটমাট হয়ে যাবে। এটি এমন পর্যায়ে যায়নি যে তাকে বরখাস্ত করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মামলা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। বরখাস্ত করতে হলে সেখানে কারো বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হতে হবে। কারো বিরুদ্ধে মামলা হলেই যে তিনি বরখাস্ত হবেন তা কিন্তু নয়। আর আদালতে যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। তাকে বরখাস্ত করা হবে।

এদিকে সংঘাতের ঘটনায় ঢাকায় শেখ সাইদ আহমেদ মান্না নামে একজনকে গতকাল গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এর আগে ১২ জনকে আটক করা হয়েছে এবং আরো কয়েকজনকে ধরার জন্য অভিযান এখনো চলছে। যাদের ধরা হয়েছে বরিশাল শহরে তাদের কয়েকজন সেখানকার সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে এ ধরনের ঘটনাকে আর বাড়তে দেয়া হবে না। নতুবা সারাদেশে এক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এর লাগান টেনে ধরা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হবে। তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দলের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, জনগণের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। এখন নির্বাচিত প্রতিনিধি বলতে সরকার যাদের বোঝাচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শুধু বরিশাল নয়, ইতোপূর্বে অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের যারা দায়িত্বে আছেন, প্রশাসনের সঙ্গে তাদের একটা সংঘর্ষ হচ্ছে, সংঘাত হচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্যর্থ, তারই লক্ষণ এটি।

অবশ্য মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি নয়। নিজেদের দলের কেউ অন্যায় করলে শাস্তি দিয়েছে- এমন কোনো দৃষ্টান্ত বিএনপির আমলে নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে শেখ হাসিনা আপন লোকদের সাজা কিংবা দণ্ড দিয়ে এবং জেলে পাঠিয়ে প্রমাণ করেছেন আওয়ামী লীগ অন্যায়কারীদের ছাড় দেয় না।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা দেয়া এবং হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত ও গুলিবর্ষণের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই শাহজালাল মল্লিক। একই অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন ইউএনও মুনিবুর রহমান। দুই মামলায়ই বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে আসামি করা হয়েছে। সাদিক আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তারের দাবিও তুলেছে সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App