×

অর্থনীতি

ব্যয় সংকোচনে সরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ০৯:১৮ এএম

ব্যয় সংকোচনে সরকার

ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বড় ধরনের ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি যানবাহন কেনা বন্ধ, বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা, আপ্যায়ন ভাতাসহ অত্যাবশ্যক নয় এমন খরচ কমানো, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় স্থগিত ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে এ নীতি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এ বাবদ গত অর্থবছরে সরকার প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করেছিল। এবার এ নীতি বাস্তবায়ন করে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে চায় সরকার। সরকারের এ উদ্যোগকে অত্যন্ত ভালো ও সময়োপযোগী বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার ঘোষণা দেয় সরকার। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় গত বছর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জরুরি সেবা, কাঁচাবাজার, নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ করে দেয়া হয়।

এতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হওয়ায় চাপের মুখে পড়ে অর্থনীতি। এরপর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার জোগান দেয় সরকার। পরবর্তী সময়ে প্যাকেজের সংখ্যা ও প্রণোদনার আকার বাড়ানো হয়। এতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের নানা প্রচেষ্টায় অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ায়।

এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ। এ সংক্রমণ ঠেকাতে গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যায় দেশ। এ সময়ে বন্ধ থাকে শিল্পকারখানা, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস। এছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। বন্ধ ছিল শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট, পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র।

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শুধু দেশের পুঁজিবাজার, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু ছিল। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি বন্ধ থাকায় দীর্ঘ হয়েছে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক বছরে করোনা মহামারিতে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারিতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার)।

জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পুরোদমেই চলছিল। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানি বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি আগের চেয়ে বেড়েছিল।

কিন্তু গত এপ্রিল মাস থেকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যাত্রাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টিকবে নাকি আবার খাদের মধ্যে পড়বে, তা নির্ভর করবে আমরা করোনা সংকটকে কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে মোকাবিলা করছি। যতদিন করোনার টিকা পুরোপুরি দেয়া না হবে, ততদিন অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এদিকে করোনার প্রভাবে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কারণ শেষ অবলম্বন হিসেবে রাখা সঞ্চয়ে আবার আঘাত এসেছে। করোনা মহামারিতে চলমান বিধিনিষেধের প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আয় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ে বড় অঙ্কের ঘাটতির মুখে তা সংশোধন করে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি। সেই হিসাবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বইছে। নতুন করে অভিঘাতের মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্প। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। ফলে রাজস্ব আহরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এজন্য চলতি বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ব্যয় সংকোচনের পরামর্শ তাদের।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দিনই সরকার ভ্রমণ ব্যয়ের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত করে। অর্থ মন্ত্রণালয় ওইদিন একটি পরিপত্র জারি করে এ স্থগিতাদেশ দেয়। এতে বলা হয়, শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় ভ্রমণ ব্যয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সব ধরনের ‘রুটিন ভ্রমণ’ পরিহার করতে হবে। এছাড়া সরকারি ভ্রমণের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত থাকবে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সরকার এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়। বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

এ খাতে ৫০ শতাংশ ব্যয় স্থগিতের কারণে সাশ্রয় হবে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের খরচ মেটাতে সরকার ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সেবার ভ্রমণ ব্যয় ৫০ শতাংশ স্থগিত করা হয়। এতে অর্থবছর শেষে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের কথা থাকলেও বিভিন্ন বিদেশি সেমিনার, মিটিং স্থগিত হওয়ায় সেটি প্রায় ২ হাজার কোটিতে পৌঁছায়। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেঁচে গিয়েছিল। ওই অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের প্রথম দিনে পৃথক আরেকটি পরিপত্র দিয়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গাড়ি কেনা বাবদ ৫০ শতাংশ ব্যয় স্থগিত করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনা বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এতে এ খাত থেকে সাশ্রয় হবে ৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

গত অর্থবছর কৃচ্ছ্রসাধনের আওতায় ৫০ শতাংশ গাড়ি কেনা স্থগিত করেছিল সরকার। সে সময়ে গাড়ি কেনা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। এতে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ ব্যয়ের ওপর অর্থ বিভাগ স্থগিতাদেশ দেয়। সংশোধিত বাজেটে এ স্থগিতাদেশ কার্যকর করা হয়। গত অর্থবছর সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।

ফলে এ খাত থেকে ২৯ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। করোনার প্রভাব না কমলে আবারও গত অর্থবছরের মতো এডিপি বরাদ্দের ১৫ শতাংশ ব্যয়ে স্থগিতাদেশ আসতে পারে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মধ্যম পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখা হতে পারে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় স্থগিত করা হতে পারে।

নতুন অর্থবছরে এডিপির আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। ১৫ শতাংশ স্থগিত করা হলে এ খাত থেকে সরকারের সাশ্রয় হবে ৩৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। এছাড়া প্রশিক্ষণ ব্যয়ের লাগামও টেনে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এ টাকা গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হবে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে সরকার ব্যয় কমানোর যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা যথার্থ। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আমাদের অনেক বেশি ব্যয় হয়। এসব ক্ষেত্রেও ব্যয় সংকোচনের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, করোনাকালে অর্থনীতি স্থবির। রাজস্ব আয়ে শ্লথগতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় সংকোচনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ অত্যন্ত ভালো ও সময়োপযোগী।

তিনি আরো বলেন, এ বছর রাজস্ব আয় তেমন বাড়বে না। যেটা করতে হবে তা হলো, যোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। তাহলে রাজস্ব জোগানে নিয়মিত করদাতাদের ওপর চাপ কমবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App