×

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের অনেক বিপথগামী তরুণ হাঁটছে আফগানিস্তানের পথে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২১, ১০:৩০ পিএম

বাংলাদেশের অনেক বিপথগামী তরুণ হাঁটছে আফগানিস্তানের পথে

তালেবান যোদ্ধারা। ছবি: সংগৃহীত

*দেশেও প্রভাব পড়তে পারে : ডিএমপি কমিশনার * গ্রেপ্তার ৪ জন তথ্য দিয়েছে : সিটিটিসি প্রধান * ভারতে আটক ৩

জঙ্গি মতাদর্শের সংগঠন তালেবানরা আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর বাংলাদেশেও নতুন মাত্রা পেয়েছে জঙ্গিবাদ। নড়েচড়ে বসেছে ধর্মীয় উগ্রবাদী। নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তারাও। আমাদের দেশের অনেক বিপথগামী তরুণ পা বাড়িয়েছে আফগানিস্তানের পথে। কেউ কেউ ভারত-পাকিস্তান হয়ে পাড়ি জমিয়েছে সেখানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কারো কারো ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পেয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নতুন করে ইসলামি শাসন কায়েম ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সুপ্ত বাসনায় মগ্ন হতে পারে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কঠোর নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে দেশে জঙ্গিদের তৎপর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে আর কখনোই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

এদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবি ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামে পরিচিতি পাওয়া দেশীয় অনেক জঙ্গি ধরা পড়লেও গোপনে তৎপর অনেকে। তাদের স্লিপারর সেলও রয়েছে। সাইবার কেন্দ্রিক সক্রিয় জঙ্গিরা নতুন করে নাশকতার কর্মপরিকল্পনা করতে পারে- এমন আশঙ্কা সব মহলের। আগস্ট মাস ঘিরে জঙ্গি ও দুর্বত্তরা বরাবরই সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে থাকে এমন আশঙ্কা পুরনো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যাচেষ্টা ও ২৪ নেতাকর্মীকে হত্যা এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট রাজধানীসহ দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলার পর আফগানিস্তান পরিস্থিতিতে আগস্ট মাস ঘিরে দেশে উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম আফগান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল সোমবার বলেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানের প্রভাব দেশেও পড়তে পারে। পথভ্রষ্ট যুবকদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে আফগানিস্তান যাওয়ার পথে ভারতে তিন জেএমবি সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। আরো অনেকেই এই পথ ধরতে চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি। এর আগে শনিবার ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে আগস্টের সার্বিক নিরাপত্তা প্রশ্নে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তালেবানের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানোর পর বাংলাদেশের কিছু মানুষ ‘ঘর ছেড়েছে’। তিনি বলেন, পৃথিবী সাইবার নির্ভরশীল। এই মাধ্যম ব্যবহার করে জঙ্গিরা তাদের সব ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, কর্মী সংগ্রহ করছে। তালেবানদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছু মানুষ পায়ে হেঁটে আফগানিস্তানে পৌঁছার চেষ্টা করছে। এদেরই কয়েকজন ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে। কঠোর নজরদারি রয়েছে। আমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে কোনো ধরনের ঘটনা না ঘটে।

গত ১০ মে চার তরুণকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাদের মধ্যে একজন একটি বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের, দুজন দুটি ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ও অন্যজন একটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। সবার বয়স ২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, তারা আফগানিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ তাদের দুই সঙ্গীর আফগানিস্তানে পৌঁছানোর খবর জানতে পেরেছে। এদের মধ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কেউ কেউ আফগানিস্তানে পৌঁছার চেষ্টা করছে। দেশের ভেতরে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমেও তারা নিজেদের সংগঠিত করছে। তাদের ঠেকাতে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যানেলসহ সাইবার ওয়ার্ল্ডে নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাছাড়া দেশের বাইরে যারা চলে গেছে তাদের দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা জানিয়েছে পুলিশ। এরপর গত ১১ জুলাই রাতে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ অভিযান চালিয়ে নাজিউর রহমান, রবিউল ইসলাম ও সাবির নামে তিন জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ধৃত তিনজনেই বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তারা ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানে উত্থানের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ থেকে শত শত জঙ্গি ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে। গত ২০ বছরে তালেবান দমনে ন্যাটোর যে অবদান ছিল, তা ন্যাটোকে প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। নিকটবর্তী দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রভাব মোকাবিলায় বেগ পেতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মধ্যপ্রাচ্যের দাতা সংস্থাগুলো অসংখ্য মাদ্রাসা খুলে বসেছে, সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে হতাশাতো আছেই। এছাড়াও নিজের দেশের প্রতি ঘৃণা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এমনিতেই তাদের জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। তালেবানের উত্থান হলে তাদের মধ্যেও এক ধরনের প্রভাব কাজ করবে। এতে বাংলাদেশসহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে ভারতও।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো ফোর্স প্রত্যাহারের পর সব শহর তারা দখলে নিয়েছে। ইতোমধ্যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদি বাস্তবে গৃহযুদ্ধ হয়, তাহলে তালেবান বিজয় উল্লাস করবে এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এতে যারা জঙ্গি পুষ্ট তারা উৎসাহী হচ্ছে, হওয়ারই কথা। কেন না ন্যাটোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর তালেবান সফলতা পেয়েছে- এমন চিন্তাভাবনা কাজ করবে। যা আমাদের দেশে জঙ্গিদের জন্য বড় উৎসাহের জায়গা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্য র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, দেশে আফগানিস্তান অনুসারী কোনো জঙ্গি নেই। জঙ্গি দমনে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকদূর এগিয়েছে। জঙ্গিদের যে কোনো ধরনের তৎপরতা শুরুর আগেই ভেস্তে যাচ্ছে। গোয়েন্দা তৎপরতা ও প্রযুক্তির সহায়তায় তারা আটক হচ্ছে। সবকটি সংস্থা সমন্বিতভাবে ও নিজেদের মতো করে এ নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সনাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, এর আগে গ্রেপ্তারকৃত চারজনের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্যই পেয়েছি। সেগুলো যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কতজন সেখানে গেছে সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে গ্রেপ্তারকৃত এই চারজনের কাছ থেকে ‘সাইন্স প্রোজেক্ট’ নামে একটি চ্যাট গ্রুপের তথ্য পেয়েছি। ওই গ্রুপে ১০ যুবক সম্পৃক্ত ছিল। তাদের চারজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এই ১০ জন গত দুই বছর ধরে একে অপরকে চেনে। এই ১০ জনের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে আফগানিস্তান পৌঁছেছে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে। তাছাড়া নোয়াখালীর আরো একজন আফগানিস্তানে যাওয়ার পথে রয়েছে। আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, বেশ কয়েকজন যুবক নিখোঁজ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তারা ভিন্ন পথ ধরেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এর সখ্যা ৫-৬ জন। তবে তিনি দাবি করেন, দেশে জঙ্গিদের তৎপর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সবসময় গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমাতায়নে এদেশের জঙ্গিদের সরব হওয়ার কোনো ধরনের সক্ষমতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. ইমরান হোসেন বলেছেন, জঙ্গিবাদ দমনে সিটিটিসিসহ বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেক বেশি সক্ষমতা সম্পন্ন। সব ধরনের আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে আমরা নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের ফলে যদি আমাদের দেশে কোনো প্রভাব পড়ে অবশ্যই সেটি আমরা বুঝতে পারব। যেই জঙ্গিবাদে জড়াবে বা নাশকতার চেষ্টা করবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশে আর কখনোই জঙ্গিরা মাথাচারা দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এখন আর আগের দিন নেই, বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে ফেলবে। জঙ্গিরা যেভাবেই নাশকতার চেষ্টা করুক, আমরা তাদের আইনের আওতায় আনবই।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েকজনের আফগানিস্তানে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দারা। রাজ্জাকের বড় ভাই সালমান খান জানিয়েছেন, গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় বাসা থেকে বের হন আব্দুর রাজ্জাক। দুদিন বন্ধুর বাসায় থাকব- এমনটি বলে তিনি সিলেটের লামাবাজার ছাড়েন। সেখান থেকে যান বন্ধু ফরিদের বাসায়। ২৫ মার্চ ফরিদের বাসা থেকে নিজ বাসায় ফেরার কথা থাকলেও আর ফেরেননি রাজ্জাক। পরে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট আব্দুর রাজ্জাকের সন্ধান দিয়ে বলছে, ভারত হয়ে রাজ্জাক এখন আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন। তিনি একা নন, তার সঙ্গে আরো অনেক বাংলাদেশি যুবক আছেন। সেখানে তালেবানদের সহযোগী হিসেবে তারা কাজ করছেন। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সম্প্রতি তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা জানান, তাদের অনেক বন্ধু কথিত হিজরতের নামে আফগানিস্তান গেছেন। তাদের মধ্যে রাজ্জাকও রয়েছেন। রাজ্জাকের ছবি দেখে তারা বিষয়টি সিটিটিসিকে নিশ্চিত করেন। রাজ্জাক কীভাবে আফগানিস্তানে গেলেন- জানতে চাইলে সিটিটিসি জানায়, প্রথমে ভারত, এরপর পাকিস্তান হয়ে তিনি আফগানিস্তান পৌঁছেছেন। হিজরতের নামে তালেবানদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। রাজ্জাক শুধু একাই যাননি। তার মতো আরো অনেক যুবক হিজরতের নামে গ্রুপ করে তালেবানদের ডাকে আফগানিস্তানে যাচ্ছেন। তারা তালেবানদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চান। এমন খবর সর্বত্র উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে তালেবান উত্থান ঘটে। এরপর থেকেই তারা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে আসছে। মার্কিন বাহিনীর সঙ্গেও তাদের লড়াই চলছে। এর মধ্যে ন্যাটো প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হলে তালেবানরা রাজধানী কাবুলসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়েছে। তালেবানের উত্থানে রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তালেবান উগ্রপন্থি হলেও আলাদা ভাবমূর্তি নিয়ে চলে। ক্ষমতা দেখিয়ে বিভিন্ন শহর ও এলাকা দখলে নিয়েছে। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের রোহিঙ্গাদের কেউ জঙ্গিবাদে জড়াবে না বা জড়ায়নি সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। সব মিলিয়ে তালেবান উত্থানে বাংলাদেশকে আরো সতর্ক হতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থার কাছে খবর রয়েছে, তালেবানদের দেখে দেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ফের আফগানিস্তানমুখী হচ্ছে। আনসার আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের সদস্যদের আফগানিস্তান যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল সেখানে মার্কিন বোমা হামলায় নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশিও ছিল। তারা ইসলামিক স্টেট (আইস) সদস্য। জিবিইউ-৪৩ বা ‘মাদার অফ অল বম্বস’ নামে এই বোমা হামলার ঘটনায় নিহতদের তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক ছিলেন। তখন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রাদমানিশ জানিয়েছেন, ‘হামলায় নিহত জঙ্গিদের অধিকাংশই পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন্স ও বাংলাদেশের।

জানা গেছে, আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবক। যার একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক। সেই আফগান-ফেরত যোদ্ধাদের উদ্যোগেই ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি (হুজি) কার্যত আত্মপ্রকাশ করে। আফগানফেরত মুজাহিদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। আফগান যুদ্ধের সময় তারা গেরিলা যুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। হুজিকে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিকে এক দফা ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হুজি আবারো নাম পাল্টে ইসলামি গণআন্দোলন বা আইডিপি (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি) নামে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করে। তারা পল্টনে দলীয় কার্যালয় খোলে এবং নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে। এর মধ্যে তাদের তৎপরতা খোলাসা হলে একে একে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন হুজির প্রধান আবদুস সালাম, একাংশের প্রধান মুফতি হান্নান (পরে ফাঁসি হয়েছে), শেখ ফরিদ, মাওলানা ইয়াহিয়াসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা। তবে দেশের বাইরে অবস্থান করে এখনো হুজি সদস্যদের উৎসাহ ও মদত দিয়ে যাচ্ছেন নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি শহীদুল ইসলাম, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আবু বক্কর। আট বছর ধরে আনসার আল ইসলাম নামে হুজির সদস্যরা সক্রিয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসিম উদ্দিন রাহমানী বিভিন্ন সময় পরামর্শ করে আসছিলেন। এর পর তারই একনিষ্ঠ অনুসারী মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আবিভর্‚ত হন।

একাধিক সূত্র মতে, কয়েক বছর ধরে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা বিভিন্নভাবে গোপনে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছিলেন। ৪ মার্চ আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফ মিঠু ওরফে হাসান, সংগঠনের ‘শেখ’ সোহান শাদ ওরফে বারা আবদুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবিরকে গ্রেপ্তারের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে বেড়িয়ে আসে। গ্রেপ্তারকৃত মাইনুল ঢাকায় মাদ্রাসা পরিচালনার নামে শিশুদের ‘জিহাদি’ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক নাশকতায় আফগানফরত যোদ্ধাদের ‘মদত’ ছিল। তাদের একজন সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক গুরু মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী। গুনবী তার অনুসারীদের বেশির ভাগ সময়ই জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আফগানিস্তানের বিষয়টি তুলে ধরতেন। ঘনিষ্ঠদের তিনি আফগানিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিভিন্ন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App