×

আন্তর্জাতিক

তালেবান আগ্রাসনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে তাজিকিস্তানে আফগান প্রেসিডেন্ট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২১, ০৮:০৪ পিএম

তালেবান আগ্রাসনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে তাজিকিস্তানে আফগান প্রেসিডেন্ট

মোল্লা আবদুল গনি বারাদার

তালেবান আগ্রাসনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে তাজিকিস্তানে আফগান প্রেসিডেন্ট

তালেবান প্রায় পুরো আফগানিস্তানে দখল কায়েমের মানচিত্র

তালেবান দখলে চলে গেছে গোটা দেশ। অবশেষে রাজধানী কাবুলও। এ পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে দেশে ছেড়ে পালালেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। বর্তমানে তিনি তাজিকিস্তানে অবস্থান করছেন। রবিবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা রয়াটার্স। ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে খবর দেয়া হয়েছে। দেশটির সরকারী কর্মকর্তা সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, তালেবানের উপপ্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আফগানিস্তানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন এবং দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত আলী আহমদ জালালিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । এদিকে কাবুলে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। এতে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছে। তালেবান আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে অনেক মানুষ। কাবুল ছেড়ে যাওয়ার লক্ষ্যেও পথে নেমে এসেছে দিশেহারা মানুষজন। হাজার হাজার লোক তালেবানের হাত থেকে বাঁচার আশায় আত্মগোপনে চলে গেছেন।

এরই মধ্যে আশরাফ গনিকে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। একই সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি গনিকে দায়ী করেন।

আফগানিস্তানের হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের প্রধান আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। তালেবান যোদ্ধার কাবুলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা পর নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট দেশের জনগণকে এই অবস্থায় রেখে দেশ ছেড়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ’র কাছে তাঁকে জবাব দিতে হবে। জনগণও এর জবাব দেবে।’ সরকারের সঙ্গে গত কয়েক মাসের শান্তি আলোচনায় গানির পদত্যাগ ছিল তালেবানের অন্যতম দাবি।

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ তালেবান দখলে: তালেবানরা দাবি করছে, তারা কাবুলে আফগান প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করেছে। এর আগেই প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে চলে যান। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়, তিনি তাজিকিস্তান চলে গেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এখন আসলে পরিস্থিতি কী - তা স্পষ্ট নয়।

স্থানীয় সাংবাদিক বিলাল সারওয়ারি জানাচ্ছেন, তালেবানের সাথে মতৈক্য হয়েছিল আশরাফ গনি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি ও তার সহযোগীরা দেশ ত্যাগ করেন। সহযোগীরা বলেন, প্রাসাদের কর্মচারীদের চলে যেতে বলা হয়, এবং এর পর প্রাসাদটি জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। তবে সরকারি কর্মকর্তারা এ খবর নিশ্চিত করেননি।

গত তিন মাসে একের পর এক শহর দখল করেছে তালেবান যোদ্ধারা। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলকেও অবরুদ্ধ করে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে রবিবার (১৫ আগস্ট) বিকেলের দিকে রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা আসে আফগান সরকারের তরফ থেকে। বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল সাত্তার মিরজাকওয়াল স্থানীয় টোলো টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় বলেন, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তালেবান কাবুলে হামলা করবে না।  এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পদত্যাগ করবেন। তবে কাবুল ঘেরাওয়ের পরই দেশজুড়ে গুঞ্জন চলতে থাকে প্রেসিডেন্ট দেশ ত্যাগ করতে পারেন। সেই গুঞ্জনই এখন সত্যে পরিণত হলো।

[caption id="attachment_302686" align="aligncenter" width="728"] মোল্লা আবদুল গনি বারাদার[/caption]

দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আশরাফ গনি রবিবার সন্ধ্যার দিকে দেশ ছেড়ে তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট অফিস বলছে, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ আশরাফ গনির যাত্রাপথ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হবে না।

এ দিন সকালে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর জালালাবাদের দখল নেয় তালেবান। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই তালেবান শহরটির দখল নিতে সক্ষম হয়। জালালাবাদ দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে অন্তত ২৮টির রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, তালেবানের উপপ্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আফগানিস্তানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। তালেবানের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বর্তমানে মোল্লা আবদুল গনি বারাদার দলটির রাজনৈতিক দপ্তরের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। আফগানিস্তানে টেকসই শান্তি ও অস্ত্র বিরতি নিয়ে দোহার আলোচনাকারী তালেবান প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

মোল্লা ওমরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কমান্ডারদের একজন হিসেবে পরিচিত মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। পাকিস্তানের দক্ষিণ করাচিতে ২০১০ এ তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও ২০১৮ সালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তালেবানের অস্থায়ী সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল সাত্তার মিরজাকওয়াল।

এ দিন সন্ধ্যার দিকে এক টুইটে তিনি বলেন, তালেবান মুখপাত্র সুহায়েল আফগানিস্তানে ‘আগ্রাসনকারীদের ক্ষমা’ ঘোষণা করেছেন।

[caption id="attachment_302624" align="aligncenter" width="700"] আলী আহমদ জালালি[/caption]

সরকারি বিভিন্ন সূত্রের বরাতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পদত্যাগের খবর আসতে থাকলেও কোন গণমাধ্যমই তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি এ তথ্য। এরই মধ্যে  আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার অন্তর্বতীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর কথাও চাওড় হতে থাকে। আফগান গণমাধ্যমে খবর আসে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিক আলী আহমাদ জালালি।

জালালি ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। আর জার্মানিতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত।

কাবুল বিমানবন্দর এলাকায় গোলাগুলি, আহত ৪০:
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, কাবুলের উপকণ্ঠে সংঘর্ষে ৪০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। কাবুলের একটি হাসপাতাল টুইট করে এ তথ্য জানায়। তালেবানরা কাবুলে ঢুকে পড়ার পর এ ঘটনা ঘটে। হাসপাতালে আসা লোকজনের বেশির ভাগই কারাবাগ এলাকায় সংঘর্ষে আহত। তবে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

কাবুল বিমানবন্দর এলাকায় গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। মার্কিন দূতাবাসের এক নিরাপত্তা সতর্কবার্তায় একথা বলা হয়। কর্মকর্তারা ওই এলাকায় থাকা মার্কিন নাগরিকদের আশ্রয় নেবার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, কাবুলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

[caption id="" align="aligncenter" width="770"]We don't want to be part of rivalry between India, Pakistan: Taliban spokesperson | Exclusive - Part III - World News সুহায়েল শাহীন[/caption]

বিবিসি’র সংবাদদাতা ইয়ালদা হাকিমের সঙ্গে সরাসরি টিভি সম্প্রচার চলার মধ্যেই যোগাযোগ করেন তালেবান আলোচক সুহায়েল শাহীন। তিনি বলেন, তারা আফগান জনগণকে ও বিশেষ করে কাবুলে বাসিন্দাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, তাদের জানমাল নিরাপদ থাকবে এবং কারো ওপর কোন প্রতিশোধ নেয়া হবে না। শাহীন তালেবানকে দেশ ও জনগণের সেবক বলে উল্লেখ করেন।

তালেবান তাদের যোদ্ধাদের কাবুল শহরে ঢোকার আদেশ দিয়েছে। তাদের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন,কাবুলে লুটপাট ঠেকানোর জন্যই এ আদেশ দেয়া হয়েছে।

[caption id="attachment_302600" align="aligncenter" width="700"] কাবুলে ঢুকে পড়েছে তালেবানরা। [/caption]

তিনি বলেন, যেহেতু সরকারি বাহিনী শহরের বিভিন্ন অংশ ও তাদের চেকপয়েন্টগুলো ছেড়ে চলে গেছে – তাই বিশৃঙ্খলা ও লুটপাট ঠেকানোর জন্য তালেবান বাহিনী শহরে ঢুকছে।

কাবুলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলি চলার খবর দিচ্ছে রয়টার্স সংবাদ সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তারা এই খবর দিয়েছে।

যেভাবে তালেবান প্রায় পুরো আফগানিস্তানে দখল কায়েম করলো:

আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সৈন্যদের বিদায়ের পর তালেবানের অগ্রাভিযান চলতে থাকে অতি দ্রুতগতিতে।

নিচের গ্রাফে দেখুন, কীভাবে দেড় মাসেরও কম সময়ের এক ঝটিকা অভিযানে তারা প্রায় পুরো দেশের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকছে:

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি বৈঠক ডাকার পরিকল্পনা করছে। পররাষ্ট্র বিষয়ে রুশ সংসদের একজন মুখপাত্র বলেছেন মানবিক বিপর্যয় রোধ করা এখন খুবই জরুরি।

ইইউর একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, আফগানিস্তানে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে কিনা এবং নারীর অধিকার মেনে চলা হচ্ছে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে কিনা।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রিটিশ সংসদে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যে এই সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য বুধবার সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকেছেন।

কাবুলের কারাগার থেকে তালেবান বন্দীদের মুক্তি:  বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, কাবুলের পুল-ই-চরখি কারাগার থেকে তালেবান বন্দীদের মুক্তি দেয়ার ছবির ফুটেজ অনলাইনে পোস্ট করেছে তালেবান সমর্থক একটি সংবাদ সংস্থা। এটি আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ কারাগার। রবিবার আরও আগের দিকে তালেবান সৈন্যরা বাগরামে আমেরিকান সমারিক ঘাঁটির সেনা কারাগারের দখল নেয়। বাগরাম কারাগারে যে পাঁচ হাজার বন্দী ছিল তাদের মধ্যে ছিল তালেবান সদস্য, উগ্রপন্থী যোদ্ধা এবং ইসলামিক স্টেটের সদস্য। নারী অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবে তালেবান:

তালেবানের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, তারা নারীদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবেন।

মুখপাত্রটি বলেন, নারীদেরকে একা বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হবে, এবং তাদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগও বহাল থাকবে।

মনে করা হচ্ছে, তালেবানকে নিয়ে সারা বিশ্বে যে উদ্বেগ রয়েছে তা অবসানের জন্যই এ বিবৃতি।

তবে ইতোমধ্যে তালেবানে দখলে চলে যাওয়া কান্দাহার থেকে খবর পাওয়া গেছে যে সেখানে ব্যাংকে কর্মরত নারীদের বলা হয়েছে, এখন থেকে তাদের জায়গায় কাজ করবে পুরুষ আত্মীয়রা।

আফগানিস্তানের অন্য জায়গা থেকেও মেয়েদের বাইরে যেতে না দেয়ার এবং বোরকা পরতে বাধ্য করার খবর এসেছে।

রোববার টোলো নিউজ নামে আফগান বার্তা সংস্থার প্রধান লোৎফুল্লাহ নাজাফিজাদা একটি ছবি টুইট করেছেন - যাতে দেখা যাচ্ছে যে কাবুলের একটি দেয়ালে থাকা মেয়েদের ছবি সাদা রঙ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন একজন লোক।

তালেবান মুখপাত্র আরো বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমকে অবাধে সমালোচনা করতে দেয়া হবে, তবে তারা 'চরিত্র হননে' লিপ্ত হতে পারবে না।

কাবুলে বোরকা কেনার হিড়িক:

তালেবানদের একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখলের খবরে গত কয়েকদিনে  রাজধানী কাবুলেও নারীদের বোরকা ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দখল করা অন্যান্য প্রদেশের মতো রাজধানী কাবুলেও নিজেস্ব আইন জারি করবে তালেবান। সেই শঙ্কা থেকেই বোরকা কিনছেন নারীরা। পোশাকের জন্য গেল সপ্তাহেই এক তরুণীকে গুলি করে হত্যা করে তালেবান বাহিনী। কাবুল দখলের আগ মুহূর্তে সেখানকার নারীরাও তৈরি হচ্ছেন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। উল্লেখ্য ৯০-এর দশকে তালেবান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন কড়াকড়িভাবে বোরকা পরে মেয়েদের বাইরে বের হওয়ার নির্দেশনা জারি করে। কেউ এই নির্দেশ না মানলে তালেবানের নৈতিক পুলিশের হাতে জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের মতো নির্মম শাস্তি পেতে হতো। তালেবানের সাম্প্রতিক ইতিহাস: 
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানি শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীদের মুখ, চুলসহ সম্পূর্ণ দেহ ঢাকা বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। মেয়েদের বয়স ১০ বছরের বেশি হলেই স্কুলে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। শরিয়া আইনের নামে তারা চালু করেছিল দোররা ও পাথর ছুড়ে হত্যার মত ভয়ঙ্কর সব শাস্তি।

২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী তালেবানকে উৎখাত করেছিল আফিগানিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু দুই দশকেও সেখানে শান্তি আসেনি।

এ বছর ৯ মার্চ থেকে সেনা সরাতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত এপ্রিলে ঘোষণা দেন, দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তার দেশে সেনাবাহিনী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। সে সুযোগটিই কাজে লাগায় তালেবান। মে মাসে শুরু হয় তাদের হামলা। জুন মাসের শেষ দিকে সরাসরি আফগান বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বাধে তাদের। তাতে আফগান বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এগোতে শুরু করে তালিবান।

তাদের দ্রুত অগ্রযাত্রায় একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানীর পতন দেখে সপ্তাহখানেক আগেও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলেছিল, আফগান সরকার হয়ত মাস তিনেক কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু  কয়েকদিনের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় গত বৃহস্পতিবারের মধ্যেই দেশটির ৩৪টির মধ্যে ২২টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তালেবান পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়। এর পর কার্যত ঝড়ের গতিতে এগোতে শুরু করে তালেবান। একে একে হেরাট, আয়বাক, গজনি, কন্দহর, তালিকান, কুন্দুজ দখল করে তারা। উত্তর দিক থেকে কাবুলের প্রবেশ পথ মাজার-ই-শরিফও একদিনেই দখল করে নেয় তালেবান। তার পর রবিবার সকালে দক্ষিণের জালালাবাদ দখল করে তারা। রবিবার সকাল পর্যন্ত মোট ২৬টি প্রদেশ তালেবানের দখলে নেয়।

আফগানিস্তান ছাড়ছেন কূটনীতিকরা:

কাবুলে তালেবানের হামলার আগেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারতসহ ইউরোপ ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর নাগরিক ও কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। তালেবানদের আগ্রাসনের মধ্যে তারা এই তোড়জোড় শুরু করেছে। ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে আনতে সেখানে ৬ হাজারের মতো সৈন্য মোতায়েন করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।

[caption id="" align="aligncenter" width="700"] হেলিক্টারে কাবুল থেকে নিজে দেশের কুটনীতিক ও নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ[/caption]

যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে তাদের কূটনীতিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। কাবুল বিমানবন্দর ও দূতাবাস সুরক্ষিত করতে নতুন করে সেনাও পাঠিয়েছে তারা। অল্প কয়েকজনের একটি ব্যাচ আফগানিস্তান ছেড়েছে, কর্মীদের বেশিরভাগই দেশটি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। তবে দূতাবাসের কার্যক্রম এখনও পুরোদমে চলছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও মিত্র জোটের সেনা এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের ফিরিয়ে আনার জন্য দেশটিতে নতুন করে পাঁচ হাজার সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর পাশাপাশি যেসব আফগান নাগরিক মার্কিন সেনাদের বছরের পর বছর সহযোগিতা করেছে তাদেরকেও আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার কাজে সহযোগিতা করবে এসব সেনা।

কাবুল ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ:

তালেবানের অগ্রযাত্রা এবং রাজধানীর প্রবেশদ্বারে তাদের অবস্থান নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের বাসিন্দারা কাবুল ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। কোন পথে শহর ছাড়বে মানুষ তা ঠিক করতে হিমশিম খাওয়ায় রাস্তায় গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা চোখে পড়ছে, কারণ মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যাংকে ভিড় জমিয়েছে।

আফগানিস্তানের সংসদ সদস্য ফারজানা কোচাই বিবিসির কাছ দিনের আরও আগে শহরের দৃশ্য বর্ণনা করে বলেন, আমি আমার বাসা থেকে দেখতে পাচ্ছি মানুষজন আসলে পালানোর জন্য রাস্তা দিয়ে ছুটছে। তিনি আরও বলেন, আমি জানি না তারা কোথায় যাবার চেষ্টা করছে। ঘর থেকে পালিয়ে তারা কোন রাস্তা দিয়ে কোথায় যাবে জানে না। তারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলেছে। খুবই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

এর আগে খবরে বলা হয় পাকিস্তান জানিয়েছে, তাদের সাথে সীমান্তের আফগানিস্তান অংশের দখল তালেবান গ্রহণ করার পর তারা তোরখাম সীমান্ত পারাপার চৌকি বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে শহর থেকে বেরুনর একমাত্র পথ এখন কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিছু কিছু মানুষ তাদের গাড়ির মধ্যে চাবি রেখেই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে এবং পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছে, জানিয়েছেন একজন বাসিন্দা।

কাবুল থেকে বিবিসির একজন সংবাদদাতা বলছেন, শহরে মানুষের মধ্যে ‘নজিরবিহীন উদ্বেগ’ দেখা যাচ্ছে। বহু দোকান বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু মানুষ বলেছে তারা জীবনে কখনও এত উদ্বিগ্ন বোধ করেনি। কিছু কিছু সরকারি দপ্তর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক সেনা সদস্য এবং পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় তাদের পদ ছেড়ে চলে গেছে। কোন কোন এলাকা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে বন্দুকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

[caption id="" align="aligncenter" width="640"]কাবুলে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নেয়া একটি পরিবার আফগানিস্তান ছেড়ে পালাচ্ছে হাজার হাজার আতঙ্কিত মানুষ।[/caption]

রাজধানী কাবুলের অনেক মানুষ গাড়িতে করে শহর থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন, এবং এ জন্য শহরের রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেউ কেউ তাদের গাড়ি রাস্তায় ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরে যাচ্ছে। শহরের বহু দোকান, সরকারি অফিস ও বাজার বন্ধ । কোথাও কোথাও সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের ডিউটি পোস্ট ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App