×

জাতীয়

হুমকির মুখে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩৪ এএম

বাংলাদেশের মূল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিশ্বব্যাংকের সংস্কার প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় হুমকির মুখে পড়বে। ফলে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা মিয়ানমার নাগরিকরা আর রোহিঙ্গা জাতিগত পরিচয়ে থাকবে না। তারা বাংলাদেশি হয়ে যাবে- এমনই অভিমত বিশ্লেষকদের। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য না হলেও বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবটি আমলে নেয়া না নেয়া নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে। তবে ক‚টনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এমন উদ্ভট প্রস্তাব না মানার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় যাতে বিলীন না হয়- সে বিষয়ে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের সোচ্চার হওয়া দরকার।

চলতি আগস্টের শুরুতে বিশ^ব্যাংক তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, বাংলাদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরও তার সব সুবিধা দিতে হবে ঢাকাকে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে জমি কেনার সুযোগ দেয়া হোক, তাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াত করতে দেয়া হোক, তাদের নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হোক। বাংলাদেশ এই প্রস্তাব মানলে বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা জানিয়েছে তারা। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা গত চার বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মূল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা বা স্থায়ীভাবে রেখে দিতে বিশ^ব্যাংকের প্রস্তাবকে অবাস্তব বা কল্পনাপ্রসূত অভিহিত করে তা নাকচ করে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ^ব্যাংকের প্রস্তাবে ঢাকা রাজি নয়। আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। এর বাইরে অন্য কিছু নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ^ব্যাংক একটা রিপোর্ট তৈরি করেছে, এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ১৬টি দেশের জন্য। যেসব দেশে শরণার্থী আছে, সেখানে তাদের আশ্রয়দাতা দেশে অভিবাসী করার বিষয়ে। যেহেতু রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয়; আমরা এটি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক শরণার্থীনীতির রূপরেখা (রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক আরপিআরএফ) তৈরি করেছে।

এর মূল সুর হচ্ছে আশ্রয়দাতা দেশে শরণার্থীদের রেখে দেয়া। ঠিক এই জায়গাতেই তীব্র আপত্তি জানিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ক‚টনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ^ব্যাংক বা ইউএনএইচসিআরের এমন প্রস্তাব বা পরিকল্পনা নতুন নয়। বহু পুরনো। ২০০৫ সালে যখন পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন তখনকার একটি উদাহরণ টেনে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, তখনো ইউএনএইচসিআর একটি প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশিদের মতো সবকিছু দিতে হবে। ওই প্রস্তাবের জবাবে তখনো আমরা তীব্র বিরোধিতা করে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।

প্রায় ১৫ বছর পর এসে ঠিক একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে ওরা। এতে আমি মনে করি প্রস্তাবের বিরোধিতা করার পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা উচিত, তোমরা কী রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তার নতুন পরিচয় দিতে চাচ্ছ? তিনি বলেন, এসব প্রস্তাব না তুলে পুরো বিশে^র দায়িত্ব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাজ করা। কিন্তু আমার বিশ্বাস তারা তা করবে না। বরং তারা বাংলাদেশকে বলছে, রোহিঙ্গাদের কাজ দেয়াসহ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে। কিন্তু বাংলাদেশ এতে রাজি হলে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় থাকবে না। এজন্য আগের মতো এবারো এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা উচিত বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।

এদিকে, এমন প্রস্তাব নিয়ে তুমুল আলোচনা হলেও এর নেপথ্যে যে রোহিঙ্গাদের পরিচয় হারিয়ে যাবে সেটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা দেশে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিশ্বব্যাংকের সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে জাতীয় সংসদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনাকে ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়ার অভিপ্রায়’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটি বলেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়ি তৈরি বা শিক্ষার সুযোগের নামে বিশ্বব্যাংক যেন ধানাইপানাই না করতে পারে।

কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা কমিটিকে বলেছি- বিশ্বব্যাংক এ ধরনের ধানাইপানাই করে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করতে চায়। এই সব প্রস্তাবনা মানা যাবে না। আমরা স্পষ্টতই এর বিরোধিতা করেছি। আমরা খুব কঠোরভাবে বলেছি, বিশ্বব্যাংকের ঘাপলার চক্করে যেন আমরা না পড়ি, বলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হবে, আমরা তাদের সাময়িক জায়গা দিয়েছি।

আপনারা তাদের মিয়ানমারে ফেরতের যাবতীয় ব্যবস্থা করুন। আমাদের এখানে থাকার জন্য তাদের ভবন তৈরি করে দেবেন। তাদের চাকরির সুযোগ করে দেবেন। জমি কেনার সুযোগ দেবেন- এসব ধানাইপানাই নয়। তাদের পড়াশোনার কথা বলছে। সেটা আমাদের এখানকার রোহিঙ্গাদের কেন? মিয়ানমারেই তো এখন ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে তাদের আগে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করুন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়ে খুশি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশও এ রকম করার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা কেন করব? এখানকার জায়গা সংকটের কারণেই আমরা ভাসানচরে তাদের নিচ্ছি। তাছাড়া এটা আমাদের বনের জমি। তাদের কারণে আমাদের বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ রূপরেখা তৈরির কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তৈরির পর ইআরডির মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। ভাসানচরের কাজে যুক্ততা নিয়ে দর-কষাকষির পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রথম বিষয়টি জানতে পারে। মিয়ানমার সেনাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্টতই তাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বিতাড়ন এবং কখনো রাখাইনে ফেরত না নেয়া। চার বছর ধরে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ^ব্যাংক-ইউএনএইচসিআরের পরিকল্পনামতো যদি তাদের আশ্রয়দাতা দেশে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) রেখে দেয়া যায়, তাহলে মিয়ানমার সেনাদের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করবে। রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষা প্রসঙ্গে যেসব প্রস্তাব এসেছে, তাতে তাদের কমবেশি বাংলাদেশি নাগরিকদের সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ভোটাধিকার, নির্বাচন- এসব শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। এসব মেনে নিলে বিশ্বব্যাংক এ বাবদ বাংলাদেশকে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে।

পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে জানান, সরকার ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তারা ‘বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’। তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির অবস্থান হচ্ছে- রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে কোনো ধরনের আলোচনায় মন্ত্রণালয় যেন বলে, ‘তারা শরণার্থী নয় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’। কাজেই আলোচনার প্রথম এজেন্ডা হবে তাদের কীভাবে ফেরত পাঠানো যাবে। মিয়ানমারে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন জানিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি নাকি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন। তবে, কবে নাগাদ হতে পারে তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এদিকে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়ন করা হলে তা এদেশে তাদের স্থায়ী বসবাসে উৎসাহিত করবে বলে বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নেয়ায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্যাম্পগুলোতে জীবনমান ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নানাবিধ বহুবার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠছে।

এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিশেষত ক্যাম্পের জীবনমানের ক্রমাগত উন্নয়ন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসবাসে উৎসাহিত করতে পারে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাবাসনের স্বার্থে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জীবনমান ও সুযোগ-সুবিধা যৌক্তিক ও সীমিত পর্যায়ে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তাব করা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা অনুমোদন করেছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার প্রত্যাখ্যান করায় বিশ্বব্যাংকের ওই রিপোর্ট মেনে নেয়ার প্রশ্নই উঠছে না। তবে এটা দেখা উচিত মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষার জন্য না লোন দিয়ে ব্যবসা করার জন্য বিশ্বব্যাংক এমন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কোনো কথা না বলে জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি সরকারই বলতে পারবে। এখানে আমি নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না। আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের এমন প্রস্তাবে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জাতিগত শোধনের পক্ষে বিশ্বব্যাংক?

তার মতে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, ইউএনএইচসিআর নয়। ইউএনএইচসিআরের দায়িত্ব এ দুরূহ কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করা, মাতবরি করা নয়। তার প্রশ্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার নিয়ে তৎপর ইউএনএইচসিআর বা বিশ্বব্যাংক মিয়ানমারে রোহিঙ্গা এবং অন্যদের ভোটাধিকার রক্ষা বা উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এ পর্যন্ত?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App