×

জাতীয়

করোনা মহামারিতে প্রযুক্তিই খুলে দেবে বাণিজ্যের সম্ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২১, ০১:৪৩ এএম

করোনায় বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। ধসে পড়েছে অনেক দেশের অর্থনীতি। মানুষের আয় কমে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। শিল্পকারখানা বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির। সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দুর্যোগের মধ্যেও উন্নত দেশগুলোর বহু ব্যবসায়ী বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন। নতুন নতুন কৌশলে ব্যবসাকে বাড়িয়েছেন বহুগুণ। করোনার এই নজিরবিহীন বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষের চাহিদা যেমন পাল্টেছে, তেমনি ব্যবসার ধরনও পাল্টেছে। চিন্তায় অভিনবত্ব ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে মানুষের চাহিদার দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন ব্যবসাকে। ইতিহাসে একটি কথা প্রচলিত আছে, সব দুর্যোগের মধ্যে নতুন কিছু বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। যারা এই সুযোগটি নিতে পারেন, তারা উন্নতির শিখরে উঠে যায়।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আয়োজিত এক সভায় অনেক বক্তাই নতুন এই বাস্তবতার কথা বলেছেন। ‘ইউএস-বাংলাদেশ টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিট’ নামক আলোচনায় করোনার বিপর্যয়ের মধ্যেই নতুন করে ব্যবসা করার কি ধরনের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তা উঠে এসেছে।

সিলিকন ভ্যালির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির শহরে নতুন পরিস্থিতিতে কি ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবছেন টেক জায়ান্টরা- তা জানার সুযোগ হলো। মহামারি আছে, বিপর্যয়ও আছে। তাই বলে মানুষের জীবন তো থেমে নেই। এই নতুন বাস্তবতায় কী প্রয়োজন মানুষের জীবনের জন্য? এ নিয়ে চলছে গবেষণা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও নতুন উপায় তৈরির চেষ্টা। এক্ষেত্রে অনেকেই বলছেন, প্রযুক্তিই একমাত্র ভরসা, যা সব মানুষকে একটি সমতল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসে। প্রযুক্তিকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেই সংকট মোচনের নতুন পথ খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের আছে একঝাঁক তরুণ জনগোষ্ঠী। একটি উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজ, এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত একটি ক্ষেত্র। সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনার কিছু চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের সহায়ক শক্তি ভূমিকা এবং ব্যক্তির উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নতুন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে।

বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালের প্রধান শামীম আহসান কিংবা স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও টিনা জাবিন প্রযুক্তিনির্ভর বাণিজ্যের বিকাশে বাংলাদেশের অগ্রগতির নানা চিত্র বিশ্লেষণ করেন। অনুষ্ঠানে সান্তা ক্লারা শহরের মেয়র লিসা গিলমোর করোনার মধ্যে প্রযুক্তির বিস্ময়কর শক্তি দিয়ে মহামারি চলাকালে বিপর্যস্ত মানবজীবনকে নতুন এক বাস্তবতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের কথা শোনালেন। নিউ নরমাল নামে নতুন যে এক বাস্তবতায় আমাদের প্রবেশ করতে হবে, তাতে মানুষের জীবনধারা পাল্টে দেবে এই প্রযুক্তি।

করোনা চলে গেলেও মানুষের জীবনে পুরনো অনেক কিছুই থাকবে না। যুক্ত হবে নতুন অনেক বিষয়। প্রযুক্তিকে সামনে রেখে নতুন এক জীবনধারায় মানুষকে প্রবেশ করতে হবে। সেখানেই রয়েছে এই উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। পেগাসাস টেক ভেঞ্চারের পার্টনার আনিসুজ্জামান করোনা মহামারির এই বাস্তবতায় নতুন সম্ভাবনাগুলোর উপরে এক বিস্তারিত উপস্থাপনা তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বাকি রোড শোগুলোর চেয়ে এটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করাই ছিল এই টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিটের অন্যতম আলোচনার বিষয়।

এই সামিটে যেমন কয়েকটি নতুন প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে যেগুলো নিয়ে গবেষণা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়াগোতে নতুন ধরনের ফেইস মাস্ক নিয়ে গবেষণা হচ্ছে যে মাস্কটি দূর থেকেই করোনা ভাইরাসকে চিহ্নিত করবে। আপনার শরীরে করোনা ভাইরাস ডেভেলপ করছে কিনা তা চিহ্নিত করার জন্য নতুন এক প্রযুক্তির গবেষণাও চূড়ান্ত পর্যায়ে। করোনা ভাইরাস ডিটেক্ট করার নতুন সেন্সর আসছে অচিরেই। কোনো রকম স্পর্শ ছাড়াই মাত্র ১১ মিনিটে ঘরে বসেই টেস্ট কিট ব্যবহার করে করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এই ধরনের উদ্ভাবনগুলো করোনা মোকাবিলার পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুম, ওয়েবেক্স, গুগল হ্যাংআউট অফিসে সরাসরি উপস্থিত না থেকেও দূর থেকে কাজের এক নতুন পরিবেশ তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। যেমন ইলোবস, ব্লুস্কেপ, স্ল্যাব এবং টান্ডেম।

করোনার এই বিপর্যয়ের মধ্যে অন্যরকম সরাসরি স্পর্শ ছাড়াই ডেলিভারি সিস্টেম ডেভেলপ করেছে দূরদেশ, পোস্ট মেইট, উবার ইট, ইনস্টাকাট এবং গ্রুবহাব। বাজারে আসার জন্য এ ধরনের নতুন প্রযুক্তি অপেক্ষায় আছে। এগুলো হচ্ছে স্টার্শিপ নিউরো ও মান্না।

টেলি হেলথ ও টেলি মেডিসিন পাল্টে দিয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থা। এ বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু প্রযুক্তি হচ্ছে টেলডক, লিভঙ্গ, ওয়ান মেডিকেল, হুমানা ও এমওয়েল। স্বাস্থ্য খাতে নতুন স্টার্টআপ প্রযুক্তি আসার অপেক্ষায় আছে ইডেন হেলথ, ৯৮.৬, সেনসলি, ক্লিনিক ইত্যাদি।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন এডুকেশন এবং ই-লার্নিং প্রযুক্তির আরো বিকাশ ঘটবে আগামীতে। ইতোমধ্যে আউট স্কুল, টিউটর গ্রুপ, এইজ অফ লার্নিং ও কোর্সএরা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

করোনা মহামারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন ও রোবটিক্সের ব্যবহার শিল্পায়নে নতুন চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়েছে। উপটেক, ক্লাউড মাইন্ড, ব্রাইট মেশিন ও রোবো ইতোমধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রযুক্তি। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড টেকনোলজির জনপ্রিয়তা বেড়েছে ব্যাপক হারে। কনসেগাছ বা রিয়েল ওয়ানের ব্যবহারের সঙ্গে এখন অনেকেই পরিচিত। বাট, ডট, স্কিপ, টায়ার ও মোবাইলের মতো প্রযুক্তি মাইক্রোমবিলিটিতে নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে। অটোনোমাস ড্রাইভিং ইউনিভার্সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে টেসলার, হোন্ডা, ফোড, মার্সিডিজ ও জিএম।

অন্যদিকে, এই করোনার নতুন বাস্তবতায় মহাকাশ প্রযুক্তির বিকাশও ঘটবে ব্যাপকভাবে। স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের ইন্টারনেট ব্যবহার যোগাযোগের প্রধান বাহন হয়ে যাবে। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত খাবার নতুন এক বাস্তবতা হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুধ, দই এমনকি বার্গারের বাজার দখল করে নিচ্ছে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত এই সমস্ত খাবার।

করোনা মহামারি আমাদের যে নতুন বাস্তবতা বা নিও নরমালে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাণিজ্য বিকাশের সুযোগ আমরা কতটা নিতে পারব, সেটা নির্ভর করছে আমাদের নিজস্ব মেধা মনন, উদ্ভাবনী শক্তি ও দক্ষতার ওপর। আগামীতে বৈশ্বিক বাস্তবতায় যে পরিবর্তনটি আসবে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আয়োজিত ইউএস-বাংলা টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিটে তার আগাম ধারণাটি অন্তত পাওয়া গেল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App