×

স্বাস্থ্য

বিধিনিষেধ নিয়ে ভজঘট!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩০ এএম

দেশে যখন থেকে করোনা ছোবল দিতে শুরু করেছে, তখন থেকে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধও শুরু হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে দেশে একবারও পরিপূর্ণ একটি লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবারই ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধের আদেশ জারি করলেও গোটা বিষয়টি হয় ঘরে ফেরার উৎসব নাহয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আরেক দফা লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ বাড়ানোর জন্য আজ মঙ্গলবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে সরকার। সূত্রের খবর, সভায় আরো সাত দিন লকডাউন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সরকার দফায় দফায় লকডাউন দিলেও তার ফল উল্টো হয় কেন? সাধারণ মানুষইবা বিধিনিষেধ কার্যকরে এত অনীহ কেন?

বিশ্লেষকরা মনে করেন, লকডাউন বা বিধিনিষেধ থেকে পুরো ফায়দা না পাওয়ার অন্যতম কারণ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যেভাবে সুপারিশ করেন, বিধিনিষেধে তা অনেকাংশে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আবার বিধিনিষেধ যা-ই থাকুক, তা পুরোপুরি কার্যকরের উদ্যোগ থাকে না। আবার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ না করে বা বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে যখন তখন বিধিনিষেধ শিথিল বা কঠোর করে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলা হয়। সর্বশেষ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খোলা ও শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরাতে গণপরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্তে রীতিমতো তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়।

সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী চলমান কঠোর লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ আগামী ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত চলার কথা। কিন্তু বিধিনিষেধ বা লকডাউন শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগে সরকারের সিদ্ধান্তে গত রবিবার থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এমন খবরে ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা পড়িমড়ি করে ঢাকায় ছুটে আসতে গিয়ে এক ভজঘট অবস্থার সৃষ্টি হয়। দিনভর মানুষের ভোগান্তি শেষে শনিবার রাত ৯টার দিকে সরকার ঘোষণা দেয়, শ্রমিকদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত নৌযান ও গণপরিবহন চলবে। আবার রবিবার দুপুরে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত নৌযান চলবে।

এসব ঘোষণা যখন সরকার জারি করে, তখন সঙ্গে শর্ত দিয়ে বলেছিল, গ্রামে থাকা শ্রমিকদের এখনই ডেকে আনা যাবে না, সেটা ব্যবসায়ীদের অনেকে মানেননি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এমন ঘোষণা যেমন আমলে নেননি, তেমনি সরকারও পুরো বিষয়টি ঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারেনি। সরকার যখন শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখনই বলে দিতে পারত সীমিত সময়ের জন্য গণপরিবহন চালু থাকবে। মানুষকে ভোগান্তি দিয়ে রাতে এসে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেয়ার কোনো দরকার ছিল না। সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্টদের এই খামখেয়ালিতে জনগণও আর লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ মানতে রাজি নয়। শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার পর দোকান মালিক সমিতি দোকান খুলে দিতে, হোটেল মালিক সমিতি হোটেল খুলে দিতে, শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে, মালিক-শ্রমিকরা গণপরিবহন খুলে দিতে সরকারের কাছে আবদার জানিয়েছেন।

এ রকম পরিস্থিতিতে আরেক দফায় অর্থাৎ ৬ আগস্ট থেকে দেশ লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধের খপ্পরে পড়বে কিনা, তার সিদ্ধান্ত নিতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে সরকার। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনলাইনে এ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সভায় ১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ১৬ জন সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, আইইডিসিআর পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেবেন। প্রসঙ্গত, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান লকডাউন আরো ১০ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানতে চাইলে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশে আরেক দফা লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ দেয়া হবে কিনা, তা আজকের সভায় চ‚ড়ান্ত হবে। তবে করোনার যা পরিস্থিতি তাতে আরেক দফা লকডাউনের ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা যায় বলে মনে করেন তিনি। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আরেক দফা বিধিনিষিধ বাড়ানো হচ্ছে। বাড়ানো হলেও কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করা হতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছে, বৈঠক থেকে কিছু শর্ত শিথিল করে পরবর্তী সাতদিনের জন্য আরেক দফা বিধিনিষিধ বাড়ানো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর আরো সাত দিনের জন্য লকডাউনের মেয়াদ বাড়লে সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অফিস সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া হতে পারে। সীমিত পরিসরে চালু করা হতে পারে গণপরিবহন। রফতানিমুখী শিল্পকারখানা চালু থাকবে বলে জানা গেছে। এদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান লকডাউন আরো ১০ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩০ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, আমরা আরো ১০ দিন বিধিনিষেধ বাড়ানোর সুপারিশ করেছি। তিনি বলেন, যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, আমরা কীভাবে এ সংক্রমণ সামাল দেব? রোগীদের কোথায় জায়গা দেব? সংক্রমণ যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে কি পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব? অবস্থা খুবই খারাপ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব বিবেচনাতেই আমরা বিধিনিষেধ বাড়ানোর সুপারিশ করেছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশের বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত ৩১ জুলাই জানান, বিষয়টি অবশ্যই আমাদের মাথায় আছে। কারণ সবকিছুর সমন্বয় আমাদের করতে হবে। সেজন্য আমরা একটু সময় নেব। ৩ বা ৪ আগস্ট এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দেব। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন প্রস্তাব আছে, সেগুলো বিবেচনা করে কীভাবে করলে এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেটি আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের কাজকর্মগুলো, যেগুলো একেবারেই অপরিহার্য, সেগুলো চালানো।

এদিকে ঠিকঠাকভাবে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন না করায় করোনা বেড়েছে বলে বিভিন্ন সময় উষ্মা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার মতে, শুধু একটি সেক্টরের কারণে আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি, অন্য সব সেক্টর ধৈর্য ধরে সহ্য করলেও একটি সেক্টর যেভাবে লাখ লাখ শ্রমিককে অমানবিকভাবে টানাহেঁচড়া করে নানাভাবে ঝুঁকি-দুর্ভোগের মুখে ঢেলে দেয়, তাদের চলাচল প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়া লাখো মানুষের মধ্যে সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! তারা কেন বোঝে না করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যের বিষয় নয়, সবার বিষয়। সমন্বিত মনোভাবে যার যার বিভাগের দায়িত্ব পালন না করলে এই মহামারি থেকে সুরক্ষা মিলবে না। আমরা একদিকে রোগ কমাই, অন্যরা আবার রোগ ছড়িয়ে দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলে, আর দোষ হয় আমাদের। রোগের উৎস যারা বন্ধ করতে পারে না, তাদের যেন কোনো দোষই কেউ দেখে না!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App