×

জাতীয়

হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২১, ০৮:২৭ এএম

প্রথম ঘটনাটি সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন রাজধানী ঢাকার। করোনায় আক্রান্ত স্ত্রী নাসরিন সুলতানাকে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে মোটরসাইকেলে করে গত বুধবার দুপুরে মুগদা হাসপাতালে এসেছিলেন আবদুর জাহেদ। সেখানে বেড ফাঁকা না থাকায় ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি নাসরিনকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নাসরিনকে আবার নিজের শরীরের সঙ্গে ওড়না দিয়ে বেঁধে জাহেদ মোটরসাইকেলে করে রওনা হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দিকে। সেখান থেকেও বিমুখ হয়ে ফিরতে হয় তাকে। কারণ একটাই ‘বেড ফাঁকা নেই’। তবে সেখান থেকে একজনের মাধ্যমে জাহেদ জানতে পারেন, মহাখালীর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে বেড খালি আছে। এ কথা জানার পর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে আগের মতো স্ত্রীকে নিজের শরীরের সাথে বেঁধে মোটরসাইকেল চালিয়ে সোজা চলে যান মহাখালী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে এভাবে ছুটে চলার অবসান হয় এখানে এসে। নাসরিনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন জাহেদ। এই ঘটনা গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের। আরো করুণ। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন করোনা আক্রান্ত মা কানন প্রভা পাল (৬৫)। একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা সংক্রমিত ছেলে শিমুল পাল। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় শিমুলেরও আইসিইউ দরকার হয়। এই সংবাদ মা জানতে পেরে খুলে ফেলেন নিজের শরীরে চিকিৎসার সব সরঞ্জাম। অনুরোধ জানান এই সিটে তার ছেলেকে ভর্তি করাতে। একপর্যায়ে চিকিৎসকরা বাধ্য হন মাকে আইসিইউ থেকে সরিয়ে ছেলেকে সেখানে নিতে। আইসিইউ থেকে বের করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয় মা কানন প্রভার। এই ঘটনাটিও দেশজুড়ে বেশ আলোড়ন তৈরি করে। এমন বিরল ঘটনায় সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি ফুটে ওঠে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান অসহায়ত্বের চিত্রও।

বড় বড় শহর কিংবা জেলা-উপজেলা, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় বেড ফাঁকা না পেয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীদের পাঠানো হচ্ছে ঢাকায়। রোগীর চাপ বাড়ায় ঢাকাতেও আইসিইউ বেড তো দূর সাধারণ বেডও ফাঁকা নেই অনেক হাসপাতালে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে রোগী নিয়ে ছুটছেন স্বজনরা। ভাগ্য ভালো হলে মিলছে বেড। কেউবা পথিমধ্যে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সেই ফেলছেন শেষ নিশ্বাস। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের ভর্তি করতে না পারার বিষয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বলেছেন, যে পরিমাণ রোগী ভর্তি আছে, এর অতিরিক্ত ভর্তি করাতে গেলে ভর্তি হওয়া রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হবে।

তৃতীয় ঘটনাটি নোয়াখালীর। সম্প্রতি নোয়াখালীর করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সাজেদা আক্তারকে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে নেয়া হয় আইসিইউতে। সেখানে সাজেদার মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ অক্সিজেনের অভাবে সাজেদার মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে রোগীর স্বজনরা ভাঙচুর চালান। সাজেদার স্বামী নুর মোহাম্মদ সুজনের অভিযোগ, একাধিকবার হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট তৈরি হয়েছিল। তাদের বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে এনে রোগীকে দিতে হয়। হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট ও চিকিৎসকদের অবহেলার কারণেই তার স্ত্রী মারা গেছে। এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে গতকাল রবিবার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য বেড বাড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। রিটে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। এর আগে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিস পাঠানো হয়েছিল। নোটিস পাঠানোর পর এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় এই রিট করে প্রতিষ্ঠানটি।

আর গতকাল দুপুরে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, হাসপাতালগুলোয় বেড বাড়ানো আর সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলোয় যতটুকু বেড বাড়ানো দরকার, আমরা বাড়িয়েছি। হাসপাতালগুলোর ভেতরে আর একটা বেড বাড়ানোরও জায়গা নেই।

দেশে করোনা সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে এবং এই পরিস্থিতিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েও কোনো সুফল মিলবে না- এমন কথা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বহুবারই বলা হয়েছে। দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালে বেড, আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেনসহ নানা সুবিধা বাড়ানো হলেও তা যে যথেষ্ট নয়, এমন কথা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই গ্রামের। পরিস্থিতি যখন খারাপ হয়, তখনই তারা হাসপাতালে আসছেন। তাই তাদের আইসিইউ লাগছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের পর এ পর্যন্ত দেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনো তা পর্যাপ্ত নয়। সংক্রমণ শুরুর পরপরই প্রধানমন্ত্রী সব জেলায় আইসিইউ ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন; কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্য- রাতারাতি সব কাজ হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিইউ মানে হচ্ছে, দুটি অংশ। একটি হলো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন- আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেনসহ অন্যান্য সামগ্রী। আরেকটি হলো দক্ষ জনশক্তি যেমন- আইসিইউ চিকিৎসক ও নার্স। যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন উপকরণ চাইলে দ্রুত কেনা যায়। কিন্তু গত দেড় বছরে আইসিইউ পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্স তৈরির জন্য দ্রুতগতিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে আইসিইউ বেড বাড়ানো যাবে যে কোনো সময়। তবে চিকিৎসক ও নার্স চাইলেই বাড়ানো যাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় বিভিন্ন হাসপাতালে মোট সাধারণ বেড আছে ১৬ হাজার ৩৩৮টি। এর মধ্যে সিট ফাঁকা আছে ৪ হাজার ৯৫২টি। ১ হাজার ৩১৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা আছে মাত্র ১৬৬টি। এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) ৮৮০টি বেডের মধ্যে ফাঁকা আছে ১৪৮টি। ১১০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন আছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২৮ হাজার ১৬টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে ১ হাজার ৮৮৮টি, অক্সিজেন কনসেটট্রেটর আছে ২ হাজার ৯৮টি।

আইসিইউ বেড খালি নেই যেসব হাসপাতালে: গতকাল রবিবার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ৫০০ শয্যা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিট, ৫০০ শয্যা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, আসগর আলী হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এ এম জেড হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশিয়ালাইজড হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, হাই কেয়ার হাসপাতাল ও আল-মানার হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই।

মোট বেডের তুলনায় বেশি রোগী ভর্তি আছে : ৫০০ শয্যা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নরসিংদীর ১০০ শয্যা জেলা হাসপাতাল, বরগুনার জেলা সদর হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফেনী (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসমূহ সহ), চাঁদপুরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতাল, সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, কুমিল্লার জেনারেল হাসপাতাল, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি আছে।

যা বলছেন কর্তাব্যক্তিরা: স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলোয় যতটুকু বেড বাড়ানো দরকার, আমরা বাড়িয়েছি। হাসপাতালগুলোর ভেতরে আর একটা বেড বাড়ানোরও জায়গা নেই। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মহাখালীতে বিসিপিএস মিলনায়তনে আয়োজিত প্রথম বর্ষ এমবিবিএস ক্লাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।

হাসপাতালগুলোর শয্যা বাড়ানো প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখনো আমরা জায়গা, ভবন খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। ভবন পাওয়া গেলেই তো হবে না, ডাক্তার থাকতে হবে, নার্স থাকতে হবে, যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। আমরা সেটারও চেষ্টা করছি। করোনার সংক্রমণ এখনো ঊর্ধ্বমুখী। দক্ষিণাঞ্চলে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লায় এখনো করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। তবে উত্তরবঙ্গে করোনা সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সেবা দেয়ার জন্য।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, করোনা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রামের মানুষ করোনাকে পাত্তা দিতে চান না। যখন পরিস্থিতি খারাপ হয়, তখন তারা হাসপাতালে আসেন। অনেকে ঢাকায় আসেন।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত : গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বুলেটিনে যুক্ত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাকসুদুল আলম বলেন, এই অতিমারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে। হাসপাতালের সক্ষমতা বেড়েছে, সঙ্গে শয্যাসংখ্যাও। কিন্তু আমরা যদি সংক্রমণ কমাতে না পারি, এই সক্ষমতা আমাদের কাজে লাগবে না।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শনাক্তের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই জটিল রোগীর সংখ্যা বাড়বে। এজন্য আইসিইউও লাগবে। তাই আইসিইউ বাড়িয়ে এর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যে হারে রোগী বাড়ছে, সেই হারে আইসিইউ বেড বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই রোগী যাতে না বাড়ে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এটি করতে পারলে রোগীর সংখ্যা কমবে। আর রোগীর সংখ্যা কমলে আইসিইউর চাহিদা কমে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App