×

জাতীয়

হাসপাতালে ‘সিট খালি নাই’ বাইরে স্বজনের করুণ কান্না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২১, ০৮:২৫ এএম

হাসপাতালে ‘সিট খালি নাই’ বাইরে স্বজনের করুণ কান্না

সোমবার ঢাকা মেডিকেলের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষা করতে করতে এক রোগী মারা যায়। ছবি: ভোরের কাগজ

‘ডাক্তার আইছে না গো, ডাক্তার আইছে না’ অ্যাম্বুুলেন্সের ভেতরে নিথর দেহে পড়ে থাকা ভাই নূরনবীর বুকের উপর আছড়ে পড়ে এভাবেই চিৎকার করে বিলাপ করছিলেন বোন ময়না বেগম। আর নূরনবীর স্ত্রী আয়েশা খাতুন যেন নিস্তব্ধ। শোকে পাথর আয়েশার মুখে ভাষা নেই, কেবল স্বামীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন প্রিয় মানুষটির দিকে। যে কিনা খানিক আগেই চোখের সামনেই ছটফটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। গতকাল রবিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের সামনের এই দৃশ্যগুলো কাঁদিয়েছে উপস্থিত সবাইকে।

ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে ১২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্সের ভিড় ঠেলে কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে এলো একটি কালো রঙের অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে নূরনবী নামের করোনা আক্রান্ত ৪৪ বছরের এক ব্যক্তি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো থাকলেও শ্বাসকষ্টে বেহুঁশ নূরনবীর বুকের পাঁজরগুলো ওঠানামা করছে দ্রুত। সঙ্গে থাকা ভাই তাজুল ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালের ভেতরে, কিন্তু ডাক্তার বা নার্স কেউই সাড়া দিচ্ছেন না।

প্রথমে টিকেট কাউন্টার, পরে আউটডোর থেকে জরুরি বিভাগ, সেখান থেকে ডাক্তারের রুম। তিনি কেবল ছুটে বেড়াচ্ছেন। প্রথমে টিকেট কেটে নিয়ে গেলেন আউটডোরে, তাকে বলা হলো এই টিকেটে হবে না। আরেকটা টিকেট নিয়ে আসেন। তাজুল মিয়া ফের গেলেন, টিকেট নিয়ে ফিরেও আসলেন। আউটডোরের দরজায় পাহারায় থাকা নিরাপত্তা কর্মী ‘আপনি দাঁড়ান’ বলে টিকেট নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে বললেন, ‘বেড খালি নাই অন্য হাসপাতালে যান’। এ কথা শুনে তাজুল মিয়া ঘামছেন। ছলছল চোখে বারবার আকুতি করছেন- ‘একবার ভেতর থ্যাইকা ডাক্তাররে একটু ডাকেন। আমার ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। একটু আসতে বলেন, আপনার পায়ে ধরি ডাক্তাররে একটু দেখতে বলেন আমার ভাইটারে’। কিন্তু নিরাপত্তা কর্মী অনেকটা ধাক্কা দিয়েই তাজুলকে সরিয়ে দিলেন আউটডোরের সামনে থেকে। তাজুল ছুটে এলেন অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে পড়ে থাকা ভাই নূরনবীর কাছে। ততক্ষণে নূরনবীর পাঁজরের ওঠানামা থেমে গেছে। বেরিয়ে গেছে বুকের ভেতর চেপে থাকা শেষ বাতাসটুকুও। তাজুল তখনো বুঝতে পারেননি তার ভাই মারা গেছেন। ছোট ভাই নূরনবীর সাড়াশব্দ না পেয়ে ফের তাজুল আবারো দৌড়ে গেলেন আউটডোরের সমানে। ফের আকুতি- ওয়ার্ড বয়কে ডেকে বললেন, ডাক্তার না আসুক একজন নার্সকে অন্তত আসতে বলেন, আমার ভাই নড়েও না। বলতে বলতে চিকিৎকার করে মাটিতে বসে পড়েন তাজুল। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত লোকজন জড়ো হয়ে বলতে থাকেন, মানুষটা আর নাই, মারা গেছেন।

কিশোরগঞ্জ থেকে সঙ্গে আসা নূরনবীর বন্ধু সোহেল তখন দৌড়ে এসে তাজুলকে বললেন আর লাগবে না ডাক্তার, তোমার ভাই আর নাই। কিন্তু তাজুল তখনো নাছোড়বান্দা। উঠে দাঁড়িয়ে আউটডোরের নিরাপত্তা কর্মীর কাছে আবারো হাতজোড় করে বলতে থাকেন- ভাই এবার অন্তত আসতে বলেন ডাক্তাররে। আমার ভাই যে মরে গেছে সেই ঘোষণা দিয়ে দেক আমরা চলে যাই। নিরাপত্তা কর্মী এবার ঢুকলেন ডাক্তারের কক্ষে। কিন্তু ভেতর থেকে উত্তর এলো, ‘কেউ মারা গেলে সেই দায় আমাদের না’। ডাক্তারের কথা শুনে তাজুল মিয়া এবার ফিরে যান অ্যাম্বুলেন্সের কাছে। ধীরে ধীরে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর পড়ে থাকা মৃত ভাইয়ের পায়ের কাছে গুটিশুটি করে উঠে বসলেন, হাতের তালুতে দুচোখ মুছতে মুছতে নূরনবীর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন ‘ভাইরে আমারে তুই মাফ কইরা দিস’। বলেই ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি টানো, কিশোরগঞ্জ যাই। এরমধ্যেই পার হয়ে গেছে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। এই ফাঁকে আরো কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স এসে জড়ো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে। যার বেশিরভাগই এসেছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে।

অন্যদিকে, নোয়াখালী থেকে এসেছেন রহমত আলি নামের সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। করোনায় আক্রান্ত এই বৃদ্ধ অক্সিজেন ছাড়া দম ছাড়তে পারছেন না। এরপরও তিনি কোনোভাবেই মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখতে চাইছিলেন না। ফলে ধীরে ধীরে তার অক্সিজেনের লেভেল কমতে থাকে। রহমত আলির সঙ্গে আসা মেয়ে ফাতেমা বাবাকে নিয়ে অনেকগুলো হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। তিনি জানান, রাজধানীর ৩টি হাসপাতালে ঘুরেছেন; কিন্তু কোথাও বেড না পেয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে রহমত আলির ছেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ফোন দেন। আরো ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর একটি শয্যা জোটে রহমত আলির ভাগ্যে।

করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। একই সঙ্গে বাড়ছে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের অস্থিরতা আর একটি শয্যার জন্য অসহায় অপেক্ষা। হাসপাতাল চত্বরে স্বজনহারাদের হাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, চোখে পানি। এমন চিৎকার, আহাজারি চোখে পড়ে প্রতিদিনই। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। যেগুলো ফাঁকা আছে সেগুলোও এখন দালালদের দখলে। যিনি মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে পারেন, তারই জায়গায় হয় এখানে। ফলে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার জন্য হাহাকার দিন দিন বাড়ছেই।

বিশেষ করে ঈদের পর থেকেই এসব হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ঢাকার বাইরের দুই শতাধিক রোগী রাজধানীতে আসছেন আইসিইউয়ের জন্য। সাধারণ শয্যার জন্য রোগী আসার সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। রোগীদের আইসিইউয়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন মাত্র দুএকটা বেড খালি হচ্ছে। কোনো রোগী সুস্থ হলে কিংবা মারা গেলেই বেড খালি হয়।

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল রবিবার শয্যা না পেয়ে অসংখ্য রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। শেষে ভর্তি হতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন অনেক রোগী। পরিস্থিতি সামাল দিতে মুগদা, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের সামনে ‘সিট খালি নেই’ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়েছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একটি সাদা বোর্ড রাখা। তাতে লেখা, ‘বেড খালি নাই’। তবে বোর্ডে কী লেখা তা দেখার সময় নেই করোনায় আক্রান্ত রোগী ও তাদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের। করোনার উপসর্গ রয়েছে ও আক্রান্ত- এমন দুজন রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে ফিরিয়ে দিতে দেখা যায় এই হাসপাতাল থেকে।

একাধিক হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপেক্ষমাণ রোগীদের চাপ অনেক বেশি। শয্যা খালি না থাকায় বেশিরভাগ রোগীকেই ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। চিকিৎসকরা বলেন, করোনা মহামারির এই সময়ে নিজেই নিজের সুরক্ষাবলয় তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতেই হবে।

রাজধানীর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। যেহেতু ডিএনসিসি হাসপাতালটি শুধু করোনা রোগীদের জন্যই। তাই ঢাকার বাইরে থেকে রোগীরা প্রথমেই এখানে আসছেন। সামাল দিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা কিছু শয্যা বাড়িয়েছি। তবে এখন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাদের সেবা দিতে হাসপাতালটিতে আরো জনবল লাগবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।

সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক ও মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, রাজধানীর কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি নেই। রাজধানীতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। এই দুই রোগের চিকিৎসা সাংঘর্ষিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App