×

জাতীয়

বিএনপিতে মূল্যহীন ২০ দল ভিন্ন পথে হাঁটছে শরিকরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ০৮:১৮ এএম

বিএনপিতে ২০ দলীয় জোট শরিকদের মূল্যায়ন নেই, মাঠের রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেই, বৈঠক নেই, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নেয়া হয় না তাদের পরামর্শ। দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক জোট কার্যত অচল। একের পর এক শরিকরা জোট ছেড়ে গেলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা প্রধান শরিক বিএনপির। জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে একলা চলো নীতিতে এগোচ্ছে দলটি। এতে জোটের ছোট দলের নেতারা ভুগছেন চরম হতাশায়। কিছু দল বিভিন্ন রাজনৈতিক ফোরামে অংশ নিচ্ছেন, অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন। কেউবা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ‘মাইনাসের’ মিশনে নেমেছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির মধ্যে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। জামায়াতকে নিয়ে এখন আর একসঙ্গে পথ চলতে রাজি নয় বিএনপি। তবে জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে। কারণ, দলটির ভেতরে এই বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ফলে কট্টর সাম্প্রদায়িক এই দলটিকে ছেড়ে দেয়ার পরের হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে আসতেই আপাতত ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

সূত্র জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারবিরোধী বাম-ডানসহ সব দলকে নিয়ে আন্দোলন গড়তে বৃহত্তর ‘জাতীয় ঐক্যজোট’ গঠনের বিষয়ে আগ্রহী বিএনপির হাইকামান্ড। ভেতরে ভেতরে জোট গঠনের তৎপরতাও শুরু হয়ে গেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাম দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছেন। তবে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ দলই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার শর্তে ঐক্যের বিষয়ে রাজি বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (খালেকুজ্জামান), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ গুরুত্বপূর্ণ বাম দল এবং কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলকেও যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন এ উদ্যোগ সফল হলেই ২০ দলীয় জোটর গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো রেখে নতুন শরিকদের নিয়ে নতুন জোট গড়ে তোলা হবে।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটে জামায়াত ছাড়া অন্য কোনো দলকেই গোনায় ধরছেন না তারা। নেতাদের ভাষ্যমতে, ২০ দলে জামায়াত ছাড়া আর আছে কে? যদি জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় তাহলে বাকি বেশিরভাগ দলই ‘ভ্যালুলেস’। তাদের জোটে থাকা না থাকা সমান। তাছাড়া যেসব দল বিগত দিনে জোট ছেড়ে চলে গেছে, তাদের প্রত্যেকেই একটা করে লেজ রেখে গেছে। বর্তমানে এমন লেজের সংখ্যা ৬টি। এসব লেজ দিয়ে দল ভারি কার ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এমন পরিস্থিতে আগামীতে দলীয় রাজনীতিতে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারে এমন কিছু দল নিয়ে জোট পুনর্গঠন এই মূহর্তে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন তারা। অন্যদিকে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতারাও মনে করছেন জোটের টানাপড়েনেই বিএনপি বেশি সমালোচিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনার কারণে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একেবারেই নেই। সীমিত পরিসরে আমরা দলীয় কর্মসূচি পালন করছি। সে কারণে জোটের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এটা সত্যি; তবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাছাড়া এই মুহূর্তে আমরা দল গোছানোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অন্যদিকে, বিএনপির নিষ্ক্রিয়তায় বসে নেই জোটের নেতারা। ২০ দল, ঐক্যফ্রন্ট এবং সাবেক সামরিক-বেসরকারি আমলারা মিলে বিএনপিকে ভেঙে নতুন জোট গঠনের মিশনে নেমেছেন। এরই মধ্যে জোট-ফ্রন্টের যে দলগুলো বিএনপি ছেড়ে গেছেন তারা বিভিন্ন জায়গায় মিলিত হয়ে প্রাথমিক আলাপও সেরেছেন। বিএনপির মূল নেতৃত্বের বাইরে একটি বিকল্প জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। মূলত তারা বিরোধী দলের ভ‚মিকায় থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোটই ১৮ এবং পরে ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। তবে নামে ২০ দল হলেও মূলত এই জোটে ছিল ২৩টি দল। যার বেশিরভাগই ভগ্নাংশ এবং অস্তিত্বহীন। এদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত মাত্র আটটি। অধিকাংশ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত নেই। কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও নেই জেলা কমিটি। কয়েকটি আবার এক ব্যক্তির এক দল নামেও পরিচিত। এমন অস্তিত্বহীন দলগুলোই একে একে জোট ছেড়ে যাচ্ছে। গত ১৪ জুলাই মূল শরিক বিএনপির বিরুদ্ধে প্রায় ডজনখানেক অভিযোগ দিয়ে জোট ছেড়ে যায় শরিকদল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।

২০ দলীয় জোট থেকে শেখ শওকত হোসেন নিলুর (প্রয়াত) নেতৃত্বাধীন এনপিপি, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর (প্রয়াত) নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি বের হয়ে গেলেও সংখ্যাতত্ত¡ ঠিক রাখতে গিয়ে যাদের দিয়ে বিএনপি এই দলগুলোর পুনর্জন্ম দিয়েছে, তাদের নেতারা সবাই প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি বিবৃতি লেখারও ক্ষমতা নেই। কেউ মানবপাচারকারী, কেউ পাসপোর্ট জালিয়াতি চক্রের সদস্য।

গত নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট শরিকদের মোট ৩৯টি আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। কিন্তু এখন জোটের কার্যক্রম না থাকায় শরিকদের কেউ পৃথকভাবে আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ফোরামে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কারণ গত এক বছরে জোটের কার্যকর কোনো বৈঠক হয়নি। সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দলকে নিয়ে একটি স্মরণসভার আয়োজন করেন। তবে এসব প্রতিক‚লতার মধ্যেও জোটের শরিক দল মেজর ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টি, লেবার পার্টিসহ ২০ দলীয় জোটের ছোট আরো বেশ কয়েকটি দল পৃথকভাবে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ভিপি নূর, মাহমুদুর রহমান মান্না ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ডাকা যে কোনো কর্মসূচিতে তারা অংশ নিচ্ছে।

বিএনপিতে ২০ দলীয় জোটের তৎপরতা চোখে পড়ছে না কেন জানতে চাইলে জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সময়মতোই জোটের কার্যক্রম শুরু হবে। এই মূহর্তে আমি শুধু বলব সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমি বলব ২০ দল মৃতপ্রায়। তবে আগামী নির্বাচনে সরকারকে ক্ষমতাচ‚্যত করতে হলে জোটগত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই। সুতরাং প্রধান শরিক বিএনপির প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই জোটকে নিয়ে বসে তারা যেন একটা একক সিদ্ধান্তে আসেন। জোট থেকে কিছু দল বের হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা বলতে পারব না, তবে আমরা এখনো বিকল্প কোনো চিন্তা করিনি।

লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জোটের বৈঠক না হলেও আমাদের সঙ্গে প্রধান শরিক দলের যোগাযোগ রয়েছে। বিএনপি একটি বৃহৎ ঐক্য করার চেষ্টা করছে। আমাদের বিশ্বাস সেখানে ২০ দলকে বাইরে রেখে তারা কিছু করবে না।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, বেশ কিছুদিন হয়ে গেল কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই জোটটি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এটা প্রধান শরিক দলের রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। তিনি বলেন, জোটের ভেতরে বেশ কিছু দল আছে যাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল, নেতৃত্বের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরাও বিএনপির সঙ্গে যেমন জোট করেছি, তারাও সেভাবে জোটে এসেছে। তবে এখন জোটে সংস্কারের সময় এসেছে বলে আমার মনে হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App