×

জাতীয়

টিকায় সমাধান খুঁজছে সরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ০৮:০৮ এএম

টিকায় সমাধান খুঁজছে সরকার

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য ফরম পূরণ করছে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় থেকে তোলা ছবি-ভোরের কাগজ

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সব মানুষের জন্য টিকা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু কোনোভাবেই কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে যেভাবে লকডাউন কার্যকর হচ্ছে, তা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির লকডাউন তাই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে খুব একটা ভূমিকা রাখছে না। অন্যদিকে মাস্কের ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহা, অসচেতনতাও সংক্রমণ বাড়ার অন্যতম কারণ। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই। তাই দুটোই এখন অনেকটা লাগামছাড়া অবস্থা। এদিকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়েও আছে প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা সরকারের নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় টিকা কার্যক্রম জোরদারের কৌশল নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে টিকার সংকটও কেটেছে। দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে সরকার, যাতে সাড়ে ১০ কোটি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেয়া সম্ভব। আরো টিকা পাওয়ার চেষ্টাও চলছে। সরকার আশা করছে সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। দেশে সব মানুষের জন্যই টিকা নিশ্চিত হয়ে যাবে। এই প্রেক্ষাপটে সবাইকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে করোনা সমস্যার সমাধান খুঁজছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তারা বলছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা বরাবরই উল্টো পথে হেঁটেছি। জনস্বাস্থ্যবিদদের বদলে ‘নন মেডিকেল’ লোকদের দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে লকডাউনের মতো একটি কার্যকর পদ্ধতি আমরা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাদের মতে, করোনার মতো একটি নতুন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে টিকাই একমাত্র অস্ত্র নয়। টিকা একটি পন্থা মাত্র। টিকার আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি। ভারতে সংক্রমণের ব্যাপকতা থেকে আমরা যেমন শিক্ষা নিইনি; তেমনি আমাদের মধ্যেই সফলতার যে কয়েকটি মডেল আছে, যেমনÑ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঝিনাইদহ- যেখানে স্থানীয় নেতৃত্ব গ্রাম, পাড়া ও মহল্লা ভিত্তিতে কমিটি করে করোনার ঊর্ধ্বগতিকে থামিয়ে মৃত্যু কমিয়ে দিয়েছে, সেটিও অনুসরণ করিনি।

করোনা মহামারি শুরুর দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় করণীয় কী, তা ঠিক করতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধ আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্তই চলবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আর বৈঠকে টিকা দেয়ার বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে টিকা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে বলেও বৈঠক শেষে জানানো হয়। এর আগে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ করোনার হাত থেকে মুক্তি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, এরই মধ্যে টিকা কেনা আমরা শুরু করেছি। টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। ব্যাপকভাবে টিকা দিতে হবে। যাতে দেশের সবাই সুরক্ষিত থাকে। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, পঞ্চাশের বেশি যাদের বয়স, হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। তারা টিকা নেননি। এই বয়সীরা টিকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। যারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) নিয়ে টিকাকেন্দ্রে যাবেন, তাকেই টিকা দেয়া হবে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাদের ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ করোনা প্রতিরোধী টিকা দেয়া হবে।

এর আগে ২৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৭৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। তারা টিকা নেননি। সরকারের প্রতি মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকা দেয়ার ব্যবস্থাও করা হবে। সম্প্রতি রাজধানীর করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত তিনটি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমি তিনটি হাসপাতাল পরিদর্শন করার সময় জেনেছি রোগীদের ৯৭ শতাংশ করোনার টিকা নেননি। তাদের অধিকাংশের বয়স ৫০ বছরের বেশি। রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন কেউ টিকা নিতে ভয় পেয়েছেন, আবার কেউ অবহেলা করে টিকা নেননি। রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এস এম আলমগীর বলেন, টিকায় মৃত্যু কমে তা প্রমাণিত। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। তাই গ্রামের বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতেই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। তবে টিকা নেয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক ড. মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ করোনার টিকা নিয়েছেন। টিকা সংক্রমণ রোধ করতে না পারলেও রোগের তীব্রতা খুব কমিয়ে ফেলে। এর কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এতে মানসিক ও অর্থনৈতিক দেউলিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। টিকা আশানুরূপ যদি কার্যকর না-ও হয় (সংক্রমণ ঠেকাতে না পারে), তারপরও টিকা ছাড়া করোনা মোকাবেলা করার অন্য কোনো অস্ত্র নেই। সময়ের কাজ সময়ে না করতে পারলে আফসোস করতে হবে। তাই সুযোগ পেলে টিকা নিতে হবে। অন্যকেও উৎসাহিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর এক বছরের মধ্যেই শুরু হয় এই ভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রম। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এ পর্যন্ত সাতটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদকৃত টিকাগুলো হলো ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, চীনের তৈরি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক্স, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেক, মর্ডানা ও জনসন এন্ড জনসন। তবে দেশে এখন পর্যন্ত টিকা প্রয়োগ হয়েছে মাত্র চারটি কোম্পানির। সেগুলো হলো- কোভিশিল্ড, সিনোফার্ম, ফাইজার ও মর্ডানা।

কবে, কোন টিকা কী পরিমাণ এলো : ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে টিকা আমদানির বিষয়ে চুক্তি হয়। এরপর ২১ জানুয়ারি ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেশে আসে ২০ লাখ ডোজ টিকা। ২৫ জানুয়ারি কেনা টিকার প্রথম চালান আসে। ওই সময় ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসে দেশে। কেনা টিকার দ্বিতীয় চালান আসে ২২ ফেব্রুয়ারি। প্রতি চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা থাকলেও ওই দিন ২০ লাখ ডোজ টিকা আসে। ২৬ মার্চ ভারত সরকার আবারো ১২ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে দেয় বাংলাদেশকে। সব মিলিয়ে ভারত থেকে ১ কেটি ২ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। এরপর ভারত থেকে কোভিশিল্ডের আর কোনো টিকা দেশে আসেনি। তবে ২৪ জুলাই কোভ্যাক্সের সুবিধার আওতায় জাপানের উপহার হিসেবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ঢাকায় আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস এন্ড ইমিউনাইজেশনস বা ‘গ্যাভি’ এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের গড়া প্ল্যাটফর্ম ‘কোভ্যাক্স’। অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোও যাতে করোনা ভাইরাসের টিকার ন্যায্য হিস্যা পায়, তা নিশ্চিত করতে এই প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্লাটফর্মের সুবিধার আওতায় ৩১ মে দেশে আসে ফাইজারের ১ লাখ ৬০০ ডোজ টিকা। চীন সরকার ১২ মে সিনোফার্মের ৫ লাখ ও ১৩ জুন ৬ লাখ ডোজ মোট ১১ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেয়। সরকারের চুক্তির আওতায় ১ ও ২ জুলাই চীন থেকে আসে ২০ লাখ ডোজ টিকা। ১৭ জুলাই আসে আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা। এ পর্যন্ত সিনোফার্মের ৫১ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। আর ১ ও ২ জুলাই মর্ডানার ২৫ লাখ ডোজ টিকা আসে দেশে। আর ১৯ জুলাই আরো ৩০ লাখ ডোজ মর্ডানার টিকা দেশে আসে কোভ্যাক্সের সুবিধার আওতায়। এ নিয়ে মর্ডানার ৫৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে।

টিকার সুবিধা বাড়াতে নিবন্ধনের বয়স কমানো হয়: প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে দেশের সব নাগরিককে ক্রমান্বয়ে টিকার আওতায় আনা হবে। সেজন্য সরকার টিকা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। টিকার সুবিধা যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ পায়, সেজন্য দুই দফা কমানো হয় টিকার জন্য নিবন্ধনের বয়সসীমা। ২৬ জানুয়ারি টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়। শুরুতে ৪০ বছর ঊর্ধ্বের নাগরিকরা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। চলতি বছরের ৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ৩৫ বছর বয়স হলেই টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাবে। ১৯ জুলাই বয়সসীমা আরো কমিয়ে ৩০ করা হয়। তবে ১২ জুলাই রাতে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি তাদের সর্বশেষ বৈঠকে টিকা নিতে নিবন্ধনের বয়স ১৮ বছরে নিয়ে আসার পরামর্শ দেয়। এরপর ১৫ জুলাই এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও জানিয়েছেন তারা টিকা নিতে বয়স ১৮ বছর করার চিন্তাভাবনা চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App