×

জাতীয়

স্বাস্থ্যসেবায় ভয়াবহ সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২১, ০৮:২৯ এএম

স্বাস্থ্যসেবায় ভয়াবহ সংকট

স্বাস্থ্যসেবা

জুলাই ও তার পরবর্তী সময়ে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়বে- এমন পূর্বাভাস অনেক আগেই দিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। ঈদের আগে লকডাউনের শিথিলের পরিণামও যে ভালো হবে না নেই হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন তারা। আর জুন মাসে পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য ও রোগীর সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা দেখে জুলাই ও আগস্টে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ার শঙ্কার কথাও আগেভাগেই জানিয়েছিলেন কীটতত্ত্ববিদরা। সেই শঙ্কাই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে শনাক্ত করোনা রোগী ও মৃতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে চলতি বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির তথ্যও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যে ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বগতি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সোমবার অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। যা এখন পর্যন্ত একদিনে মৃত্যুর হিসাবে সর্বোচ্চ। আর এই সময়ের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার ১৯২ জন। এটিও সর্বোচ্চ শনাক্ত। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১২৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ বছরের এখন পর্যন্ত এটি একদিনে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের রেকর্ড। করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত, মৃত্যু এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঢাকাতেই বেশি।

এদিকে মহামারির দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় করণীয় কী, তা ঠিক করতে গুরুত্বপূর্ণ এক সভায় বসছে সরকার। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এই বৈঠক হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনায় ঢাকা বিভাগে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা বিভাগভিত্তিক হিসাবে সর্বোচ্চ। আর সাত হাজার ৯৫৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এটিও বিভাগ অনুযায়ী সর্বোচ্চ। ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২৩ জনের মধ্যে ঢাকাতেই শনাক্ত হয়েছেন ১২০ জন।

এখন পর্যন্ত ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৭ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সাত লাখ ২০ হাজার ৯২১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। আর মোট মৃত ১৯ হাজার ৫২১ জনের মধ্যে এই বিভাগেই মৃত্যু হয়েছে নয় হাজার ১১৯ জনের। আর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৪৩০ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৯৯ শতাংশই ঢাকায়। এদিকে করোনার চিকিৎসা আর ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা এক হাসপাতালে দেয়া সম্ভব নয় বলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় আলাদা হাসপাতাল নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে জনগণকে অবহেলা না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার এন্টিজেন কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষাটি বিনামূল্যে করার সুযোগ রয়েছে। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে বিলম্ব না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার অনুরোধ জানান তিনি।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির উপদেষ্টা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা করোনার ভয়াবহতা এখনো বুঝতে পারছি না। কমিটির পক্ষ থেকে আমরা লকডাউন আরো বাড়ানের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে তা শিথিল করা হলো। আমরাদের কাজ পরামর্শ দেয়া। পরামর্শ বাস্তবায়ন যারা করবেন তারা যদি পরামর্শ না শোনেন সেখানে আমরা কী করতে পারি? এখন যা হবার তাই হবে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কী করতে পারি? পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা দেখেও আমরা শিক্ষা নিলাম না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে চিত্র আমরা দৈনিক দেখছি তা সত্যিই ভয়াবহ। কিন্তু আমরা কি এই পরিস্থিতি দেখেও কিছু শিক্ষা নিয়েছি? আমার তো মনে হয় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। আগস্টের মাঝামাঝি আমরা সংক্রমণের একটি চ‚ড়ায় পৌঁছাতে পারি।

আর দেশে ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা বাড়া প্রসঙ্গে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রোগী ব্যবস্থাপনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। মশকনিধনে দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা খুব একটা চোখে পড়ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর-এই চার মাস মূল মৌসুম। কয়েক দিনের থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টি এডিস মশার বংশবিস্তারে প্রভাব ফেলছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে পাঁচ লাখ মানুষ হেমোরেজিক জ্বরে ভোগে আর কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষ মারা যায়। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশই শিশু।

এদিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন পাঁচজন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে। গত এক বছরে যেখানে মাত্র ৬৫ জন শিশু এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল; সেখানে গত দুই মাসেই ৬৫ জন ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থা হওয়ায় চারজনকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা হয়েছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, গত দুই মাস ধরে ব্যাপকভাবে শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। গত দুই মাসে আমাদের এখানে ৬৫ জন ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ৩৮ জনের চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে দুই শিশু মারা গেছে। স্বাস্থ্যবান ও বেশি ওজনের শিশুদের বেশি গুরুতর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি রোধ করা সম্ভব না হলে ঘরে ঘরে এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। ওই আট বছরে কখনোই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ আবার বাড়তে শুরু করে। ২০১৭ সালে কিছুটা কমে ২০১৮ সালে আবার বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে পৌঁছায়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সন্দেহে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছে ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে। বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায় এর মধ্যে ১৭৯ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

আইইডিসিআরের জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গতে আক্রান্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন শিশু, শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী। ২০২০ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব একটা ভয়াবহ না হলেও চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকেই যাচ্ছে। এ পর্যন্ত আইইডিসিআরের কাছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য এসেছে। তবে এ নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনা শেষে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App