×

জাতীয়

ইয়েস, বাট নট নাউ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৫ এএম

পরাধীন ব্রিটিশ-ভারত থেকে পাকিস্তানের কালো অধ্যায় পেরিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই মহান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো নানা ঘটনা, যার কারিগর হিসেবে কেউ আখ্যায়িত হয়েছেন নায়কের অভিধায়; কেউবা আবির্ভূত হয়েছেন খলনায়কের চরিত্রে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সেসব ঘটনা ও তার নায়ক-খলনায়কদের কার কি ভূমিকা, তাই নিয়েই অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গ্রন্থ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’। সম্প্রতি ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বইটি। এর কিছু অংশ তুলে ধরা হচ্ছে পাঠকদের জন্য।

৩ মার্চ পল্টন ময়দান। ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে আয়োজিত বিশাল বিক্ষুব্ধ জনসভা। সভায় শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে সভার শুরুতে পরিবেশিত হয়। উক্ত সভায় আ স ম আব্দুর রব কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে ২ মার্চ যে পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল তা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন- তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী। সেদিন পল্টনের জনসভায় ‘জয়বাংলা’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা, একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি পূর্ণ বিকাশ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু, ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। ইশতেহারে সাম্য, সমতা, পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রব্য বর্জন, স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র প্রস্তুতি, জাতীয় সংগীত, পতাকায় স্বাধীন বাংলার ভূখণ্ড এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো জনতার জনসভায় উপস্থিত হন।

প্রশ্ন থেকে যায়- ১ তারিখে তিনি বলেছিলেন ৭ তারিখে তিনি তার কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তাহলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কেন এসেছিলেন? তার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, সে সময় পাকিস্তান সামরিক জান্তার মধ্যে একটি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছিল। বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না যে, জেনারেলরা তাঁর হাতে ক্ষমতা না দেয়ার জন্য জোরেশোরে ইয়াহিয়া

খানকে চাপ দিচ্ছিলেন। যে কোনো সময় তাদের চক্রান্ত কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ১ তারিখ থেকেই গুজব ছিল প্রধান সেনাপতি জেনারেল হামিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর যিনি বাঙালিদের প্রতি বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি সহনশীল ছিলেন তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। বসানো হয় লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে। সেই ইয়াকুব খান সামনে কী হতে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করে পদত্যাগ করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর একটি বার্তা পাঠান।

৩ মার্চ চট্টগ্রামে এম.ভি. সোয়াত জাহাজ থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ নামানোর সময় জনতার সঙ্গে সৈনিক ও নাবিকদের সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষে শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়। ঢাকায় জনগণ কারফিউ ভাঙে। ‘জয়বাংলা’ ও ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’ সেøাগানে রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে এবং রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কারফিউ ভেঙে বিরাট এক মিছিল গভর্নর হাউসের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানে গুলিতে দুইজন নিহত এবং ৬৮ জন আহত হয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র বাংলায় হরতাল পালন করুন। সামরিক বাহিনীর প্রতি তিনি আহ্বান জানান, আপনারা ব্যারাকে চলে যান। কারফিউ প্রত্যাহার করেন।’

পাকিস্তানি জেনারেল কামাল মতিনউদ্দীন লিখেছেন, ‘ওই দিন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার ছবিতে আগুন লাগানো হয়। পাকিস্তানের পতাকা পদদলিত করা হয়। সেনাবাহিনীকে গালি দেয়া হয়। ক্যান্টনমেন্টে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। খাদ্য সরবরাহও বন্ধ করা হয়। ঢাকার টেলিভিশন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ৩ মার্চ টেলিভিশনে তারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত প্রচার করে। সরকারি স্টক থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। ঢাকা সেনানিবাসকে ঘেরাও করা হয়। ইকবাল হলের নাম পাল্টিয়ে জহুরুল হক হল নাম দেয়া হয়। জহুরুল হক পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন সার্জেন্ট ছিলেন। যিনি আগরতলা মামলায় কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। জিন্না হলের নাম বদলিয়ে সূর্যসেন নামকরণ করা হয়।’

এমনি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সেজন্য তিনি পল্টনে চলে এলেন। পল্টনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জনতার সামনে আসতে বাধ্য হয়েছি। ইচ্ছা ছিল ৭ মার্চ সব কথা বলব। কিন্তু পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের সভায় এসেছি। জানি না আপনাদের সামনে আর বক্তৃতা করতে পারব কী পারব না। তাই আজ স্পষ্টভাবে আমি আমার কর্মসূচি জানিয়ে দিতে এসেছি। যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে এবং ভোট দিয়েছে আমি মরে গেলেও আমার আত্মা তাদের সুখ ও সমৃদ্ধি যখন দেখতে পাবে, তখন শান্তি পাবে। ৭ কোটি মানুষকে হত্যা করতে পারবেন না। আমি না থাকলেও বাংলার মানুষ তাদের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যাবে।’

তার বক্তৃতায় নির্দেশ ছিল- সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা যেন নির্ভীকভাবে সকল খবর পরিবেশন করেন। যদি কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তা মানবেন না। সংবাদপত্র মালিক যদি এতে বাধা দেয় তাহলে চাকা বন্ধ করে দেবেন।

তিনি বলেন, ‘আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। এই সময়ে কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, সরকারি অফিস, কলকারখানা, রেল, স্টিমার, বিমানসহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে। সরকারি কর্মচারীরা অফিস-আদালতে যোগ দেবেন না। সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সকল প্রকার ট্যাক্স ও খাজনা প্রদান থেকে প্রত্যেকে বিরত থাকুন। আমি সংবাদপত্র, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, বন্ধ না করার নির্দেশ দিয়েছি।’

এ জনসভা ছিল একটি জঙ্গি সমাবেশ। মিছিল-সমাবেশের অগণতি মানুষের হাতে বাঁশের লাঠি, বল্লম, লোহার রড, টেটা, তলোয়ার এবং দেশি বন্দুক ছিল। সভায় বারবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য সেøাগান দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো হটকারী চাপকে উপেক্ষা করে বললেন, ‘৭ মার্চ আমি আমার কথা বলব। যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও বেঈমানি করব না। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে ছাড়ব।’ ওই দিন একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন?’ বঙ্গবন্ধু অব দ্য রেকর্ডে বলেন, ‘ইয়েস, বাট নট নাউ’।

৫ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বিবৃতিতে বলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র জনতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে আমি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ তাজউদ্দীন বলেন, ‘সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনমূলক কাজের নিন্দা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অথচ আমরা জানি বিদেশি হামলা থেকে দেশকে রক্ষার জন্যই এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার কথা। কিন্তু তা ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদের ওপর।’ জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও উচিত বাংলাদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা বন্ধের দাবি তোলা।’

আগামীকাল প্রকাশিত হবে ‘টপ সিক্রেট সিগন্যাল’

‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App