×

জাতীয়

তদন্ত সংস্থায় ঝুলে আছে সাতশ’র বেশি অভিযোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২১, ০৮:৪৩ এএম

মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নিধনের মাস্টারমাইন্ডখ্যাত শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শেষে আদালতের ঘোষিত দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূল পর্যায়ের স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে বেড়েছে জনআকাক্সক্ষা। সবার প্রত্যাশা, গ্রামে-গঞ্জে যারা হানাদারদের দোসর হয়ে ঘটিয়েছে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, চালিয়েছে মানবতা-বিবর্জিত নির্যাতন তারাও যেন কোনোভাবেই রেহাই না পায়। গত কয়েক বছরে এমন সাত শতাধিক অভিযোগ এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। বর্তমানে মামলাগুলো তদন্তের অপেক্ষায় ঝুলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব সীমিত জনবল দিয়ে এত মামলার তদন্ত শেষ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব।

তৃণমূলের মানুষের এই আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলছেন বিচার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারে যে প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে, আর দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে সরকারকে এমন উদ্যোগই নিতে হবে। তাদের মতে বিচার ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনে দেশের সাতটি বিভাগেও গঠন করা যেতে পারে সাতটি ট্রাইব্যুনাল। জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থায় সারাদেশ থেকে শত শত অভিযোগ এসেছে। আরো অভিযোগ প্রক্রিয়াধীন আছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের মার্চে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর সঙ্গে যাত্রা শুরু করে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন। বিচারে গতি বাড়াতে এক বছর পর গঠিত হয় আরেকটি ট্রাইব্যুনাল। ব্যক্তি ছাড়াও সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে তদন্ত সংস্থা। গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্মান্তরসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত করে প্রসিকিউশনে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এরপর বিচারের জন্য তা পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যে গতিতে বিচার চলছে, তাতে বিচারাধীন ৩৫টি মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে আরো অন্তত ১০ বছর। আর এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সাত শতাধিক অভিযোগের বিচার করতে সময় লাগবে ১৯৪ বছর। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরুর অপেক্ষায় আছে আরো ৪টি মামলা। এরই মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশন বিভাগে এই মামলাগুলো জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। বর্তমানে তদন্ত সংস্থার কাছে তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ৩২টি। বিচারাধীন মামলা শেষ করে এই মামলাগুলোর বিচার শেষ করতে লাগতে পারে আরো ২০ বছর। বিচার প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ায় বিচারপ্রার্থী ও মানবতাবিরোধী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তদন্ত সংস্থায় জনবল সংকটের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। তদন্ত সংস্থায় জনবল ৫৯ জনের স্থলে আছে ১৭ জন। ৯ জন সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) স্থলে আছেন পাঁচজন। ১৬ জন পরিদর্শকের স্থলে চারজন এবং উপপরিদর্শক ৩৪ জনের স্থলে আছেন ৮ জন।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর গত প্রায় ১০ বছরে রায় হয়েছে ৪২টি মামলার। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ১১৬। গড়ে বছরে রায় হয়েছে ৪টি করে মামলার। ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১০টি মামলা। এর মধ্যে ৬টি রায় কার্যকর হয়েছে। আসামির মৃত্যুর কারণে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩টি মামলা। দুইজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির রায় কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গত চার বছরে কোনো রায় কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ জামায়াতের সুরা সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হয়েছে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। জানা গেছে, প্রথমত, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, দ্বিতীয়ত, একজন বিচারপতি দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারে তিন বিচারপতির অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো মামলার রায় দেয়া যায় না। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে শুধু দুয়েকটি সাক্ষ্যগ্রহণ এবং তারিখ নির্ধারণের মতো কাজই চলছে।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, সাতশ’র মতো মামলা আমাদের এখানে আছে। এ মামলাগুলোতে প্রায় তিন হাজারের মতো আসামি রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লার ৮টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। আমরা দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। এছাড়া অনেক মামলায় আসামি মারা গেছে, সাক্ষীও পাওয়া যাচ্ছে না। ৩২টি মামলা এ মুহূর্তে তদন্তাধীন রয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসে ৪-৫টি মামলার চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন আমরা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করতে পারব। সাত শতাধিক মামলার তদন্ত শেষ করতে কত সময় লাগবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এটি শেষ করতে পারব না। পদ অনুযায়ী, আমার তদন্তকারী কর্মকর্তাও প্রায় অর্ধেকের চেয়ে কম আছে। কেউ চলে গেছে, অনেকে অবসরে গেছে কিন্তু বিকল্প আর দিচ্ছে না। বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি, বারবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের যদি তদন্ত কর্মকর্তাই না থাকে, তাহলে আমরা এত মামলার তদন্ত শেষ করব কীভাবে? সরকারের আগ্রহের কমতি রয়েছে বলে মনে করেন কিনা, জবাবে তিনি বলেন, সেটা তো আমি বলতে পারি না। আপনারাই ভালো বোঝেন।

বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে ২টি ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য চলমান থাকায় মামলা নিষ্পত্তির হার বেশি ছিল। বর্তমানে মাত্র একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে। ফলে ট্রাইব্যুনালে বছরপ্রতি মামলা নিষ্পত্তির হার ৫/৬টির মতো। বিচারপ্রার্থী ও শহীদ পরিবারগুলোর দাবি মতে দ্রুত এসব মামলার বিচার শেষ করার জন্য আরো এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন। নয়তো বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে আরো ১০/১৫ বছরের অধিক সময় কেটে যাবে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিও বিচার দ্রুত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। তাই আমরা আশা করছি, দ্রুত সরকার এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে অতিদ্রুত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে।

এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অন্যতম ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মন্থরগতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ৪০ বছর পর শেখ হাসিনা আবার সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে নিজেকে ইতিহাসের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই বিচারটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার জন্য আমরা প্রতিটি বিভাগে একটি করে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। আপিল বিভাগে হাজার হাজার তালিকার মধ্যে পড়ে এই বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে। আমরা বলেছি, এই মামলাগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। না হলে আইন সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালেই শুনানির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার শূন্য হওয়া পদগুলোতে জনবল নিয়োগ দেয়ারও দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এ ব্যাপারে কেন নজর দেয়া হচ্ছে না, জানি না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App