×

জাতীয়

শিথিলের মাশুল ঈদের পর!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২১, ০৮:৪৬ এএম

শিথিলের মাশুল ঈদের পর!

অনুমতি ছাড়াই মূল সড়কে অবৈধভাবে বসেছে কুরবানির পশুর হাট। ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। গতকাল কচুক্ষেত থেকে তোলা। ছবি: ভোরের কাগজ

টানা দুই সপ্তাহ কঠোর লকডাউনের পর ঈদ সামনে রেখে ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করে সরকার। বাস-ট্রেন-লঞ্চ চলার ব্যবস্থা করা হয়। খুলে দেয়া হয় অফিস, আদালত, দোকান ও শপিংমল। কুরবানির পশুরহাটও বসে রাজধানীসহ দেশের সব এলাকায়। কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই দেখা যায়নি। এখন তার মাশুল গুনতে হবে- এমনটাই মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে করোনা সংক্রমণ এবার ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ। সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। জার্মানির গেøাবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএ-আইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সাতটিতেই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। হাসপাতালে ঠাঁই নেই। অক্সিজেন ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বেড না পেয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

দেশে করোনা সংক্রমণের পর দুটি রোজার ঈদ এবং একটি কুরবানির ঈদ উদযাপিত হয়েছে। এই তিন ঈদের পরই দেখা গেছে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে লাফিয়ে। বেড়েছে মৃত্যুও। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না। কারণ সংক্রমণ বাড়লেও ঈদে মানুষের বাড়ি যাওয়ার চিরচেনা দৃশ্যের হেরফের হয়নি একটুও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদে যেভাবে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে, কুরবানির পশুরহাটে ঘোরাঘুরি করছে, যেভাবে মেলামেশা করছে, শপিং করছে- তাতে সংক্রমণেরগতিরোধ করা বহুগুণ কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে করোনা সংক্রমণ এতটাই বাড়তে পারে, হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হবে না। রীতিমতো বিনাচিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

ঈদের পর করোনার সংক্রমণ যে বহুগুণ বাড়বে সে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের; সরকারও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে লকডাউন শিথিলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণ না কমাতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে সম্ভব হবে না সে কথাও জানিয়েছে তারা। আর সে কারণেই সম্ভাব্য সংক্রমণের চেইন ভাঙতে ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের ঘোষণাও আগে থেকেই দিয়েছে সরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মন্দের ভালো মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে সরকারের এই কৌশল কতটা কাজে লাগবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে তাদের মধ্যে। কেননা সরকার কঠোর লকডাউন ঘোষণার পরও যে চিত্র দেখা যায় তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সেনাবাহিনী নামিয়েও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো যায়নি। ব্যবসায়ীদের চাপে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস খুলে দিতে হয়েছে। বাস শ্রমিকদের চাপের কাছেও সরকারের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সরকার আমলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আর পরামর্শক কমিটিসহ জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এবারো তেমনটি লক্ষ্য করা গেছে।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলছেন, লকডাউন শিথিলে সরকারের নির্দেশনায় তাদের ‘সায়’ ছিল না। তারা বলছেন, বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা তাদের পরামর্শের বিপরীত চিত্র। এ সময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ারই শামিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেখানে বারবার ভিড় এড়িয়ে চলার কথা বলছে, সেখানে সংক্রমণের ‘পিক টাইমে’ এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে।

লকডাউন শিথিলে সংক্রমণের হার বাড়তে পারে বলে ১৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে শঙ্কা প্রকাশ করেন স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, দেশের প্রায় সব বিভাগেই করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে হাসপাতালের বেড প্রায় শেষ হয়ে আসছে। চিকিৎসাসেবা দিতে দিতে ডাক্তাররাও ক্লান্ত। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না। আর সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে ঈদের যে আনন্দ, সে আনন্দ মানুষ করতে পারবে না। আমরা এমনভাবে যাতে ঘোরাফেরা না করি, ঈদের আনন্দ যেন দুঃখে বা ট্র্যাজেডিতে পরিণত না হয়ে যায়। সংক্রমিত হয়ে মানুষ মারা গেলে ঈদ আর ঈদ থাকবে না, তখন আমাদের মাতম করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির এক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার যা, তা দুই মাস আগেও কেউ কল্পনা করেননি। ভারতের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখেও আমাদের শিক্ষা হয়নি। পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে সেই বিষয়ে আগাম প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটিও নেয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এখনো অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দূরত্ব ঘোচেনি। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ দূরের ভাবনা ভাবতে চান না। যে কারণে এত বড় বিপর্যয়। আগামীতে আমাদের আরো বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, সংক্রমণ রোধ করা সরকারের একার দায়িত্ব নয়। প্রত্যেকেরই নিজের জায়গা থেকে সচেতন থাকতে হবে। ঈদ ও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই সরকার লকডাউন শিথিল ও পরবর্তীতের লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের কাজ পরামর্শ দেয়া। আমরা আমাদের কাজটি করছি। কিন্তু যারা এটি বাস্তবায়ন করবেন তারা আমাদের পরামর্শ কীভাবে নেবেন সেটি তাদের বিষয়। আমাদের জনগণ স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই মানে না। মাস্ক পরা আমরা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি। সংক্রমণের এই পর্যায়ে এক মুহূর্তের শিথিলতা আগামীর দিনগুলোকে আরো বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলবে। এ মুহূর্তে আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে অধিদপ্তরের দুই মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ও অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম প্রতিবারই বলছেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলে পরিস্থিতি কঠিন হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App