×

জাতীয়

পাঁচ বছরেও তৈরি হয়নি পরিকল্পিত চামড়া নগরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ০৯:০০ এএম

পাঁচ বছরেও তৈরি হয়নি পরিকল্পিত চামড়া নগরী

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া নগরীতে শুরু থেকেই করিম লেদারস লিমিটেডের নামে প্লট বরাদ্দ থাকলেও নেই কোনো কার্যক্রম। ছবি: মাসুদ পারভেস আনিছ।

স্বচ্ছ টলমলে জল, ছলাৎছলাৎ শব্দে পালতোলা নৌকার বয়ে চলা। কিংবা জালে আটকে থাকা ভরপুর মাছে জেলেদের চোখ জলজল হয়ে ওঠা। চোখ আটকে যাওয়া ডলফিন, শুশুকের দুরন্তপনা। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরীর সেই চিরচেনা ছবি এখন রূপকথা!

পরিবেশ দূষণ আর বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াপল্লী স্থানান্তর করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। উল্টো এক নদী বাঁচাতে গিয়ে এখন দূষণ কেড়ে নিয়েছে আরেক নদীর প্রাণ। রাসায়নিক বর্জ্যরে থাবায় বর্ষায়ও কালো দেখায় এ নদীর পানি। দুর্গন্ধে নদীর পাড়ে যাওয়া দুরুহ ব্যাপার। জেলের কাছে মাছ এখন ‘সোনার হরিণ’। পানি ছুঁলেও চুলকায়। চামড়াপল্লীর বর্জ্যবিষে ধলেশ্বরীর চারপাশেই এ রকম ‘বিভীষিকাময়’ অবস্থা। হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের পাঁচ বছরেও পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি সাভারের চামড়া নগরী।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পরিচালিত সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর সব ধরনের বিষাক্ত বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। চামড়াপল্লীর অবকাঠামো ও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ ১৮ বছরেও শেষ করতে না পারায় বর্তমানে তিলে তিলে ধুঁকছে ধলেশ্বরী। এদিকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো পরিবেশসম্মতভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় বেসরকারি মালিকদের পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটির কাছে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুরোপুরি হস্তান্তর করা যাচ্ছে না।

ট্যানারি মালিকরা জানান, বর্তমানে তাদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স। ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল এন্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং তা এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সহায়ক হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, সিইটিপিকে যুগোপযোগী না করে ট্যানারি স্থানান্তর ছিল সরকারের অনেক বড় একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ১৩২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ ইস্যুতে চামড়ার আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এই ব্যবসায় ভাটা পড়তে থাকে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে হাজারীবাগের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ায় অনেকে উৎপাদনে যেতে পারেননি। ফলে ব্যাংকের খেলাপির খাতায় তাদের নাম উঠে যায়। তিনি বলেন, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, সুয়েজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম এবং সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম শিগগিরই বাস্তবায়ন করা জরুরি। এলডব্লিউজি সনদ না পেলে এ খাতের অনেক উদ্যোক্তাই পথে বসবেন। ২০১৭ সাল থেকে লাগাতার লোকসানে ইতোমধ্যে চার-পাঁচটি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান। তিনি আরো বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে সিইটিপি নির্মাণে নিযুক্ত চাইনিজ কোম্পানিটি গত ৩০ জুন কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বিসিকের কাছে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। এরপর বিসিক একটি কোম্পানি গঠন করে তাদের কাছে সিইটিপির দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে। তারা কাজ শুরু করলেই বোঝা যাবে- তা কতটা কার্যকর। তবে আমাদের জানা মতে, কিছু অসম্পূর্ণতা রয়েছে, যা সংস্কার না করলে ট্যানারি মালিকরা বাধার সম্মুখীন হবেন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়াশিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে, ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এরপর থেকেই ধস নামতে শুরু করে এ খাতের রপ্তানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরো কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরো কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে এসে দাঁড়ায়। অথচ তিন বছর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরকে চামড়াবর্ষ ঘোষণা করেছিল সরকার। লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালে এ শিল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় হবে। তবে বিভিন্ন পক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপে এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন থেকে অনেক দূরে সরে আসতে হয়েছে খাতটিকে। আশার কথা হচ্ছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কিছুটা প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের এই উৎস। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। এ অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশের মতো।

এ শিল্পের মালিকার জানান, চীনা ঠিকাদার ও বিসিকের গাফিলতিতে দীর্ঘ ৮ বছরেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সফলতার মুখ দেখেনি। ভবিষ্যতে এটি আলোর মুখ দেখবে বলে আশাও নেই তাদের। এতে বিদেশি ক্রেতাদের জোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) বাংলাদেশমুখী হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারি সংস্থা বিসিক বলছে, কিছু ক্ষেত্রে ত্রæটি থাকলেও ট্যানারি মালিকদের অসহযোগিতার কারণে সিইটিপি পুরোপুরি সফল হতে পারছে না।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবদুর রহিম। যিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নিবিড়ভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তার মতে, হেমায়েতপুরের হরিণধরার এ চামড়া শিল্পনগরী এখনো সফল না হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ দায়ী। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, এখানে স্থানান্তরে শুরু থেকেই শিল্প মালিকদের গা ছাড়া ভাব ছিল। এজন্য শুরু থেকেই তারা নানা অভিযোগ করেন। যেমন- জমির দাম ঠিক না করা, প্লটের ইজারা দলিল বুঝে না পাওয়া, সিইটিপির নির্মাণ শেষ না হওয়া, কঠিন বর্জ্যরে খোলামেলা ডাম্পিং ইত্যাদি। আবদুর রহিম বলেন, বিসিকের হাতে শিল্পনগরী উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়াটা শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এছাড়া সিইটিপি নির্মাণে ঠিকাদার বাছাইয়েও ভুল ছিল বলে মনে করেন তিনি। রহিম বলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না এমন একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০১২ সালে সিইটিপি তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, শিল্পনগরীর দক্ষিণ দিকের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন এলাকায় সিইটিপির অবস্থান। তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে উন্মুক্ত স্থানে চামড়ার কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বর্জ্যরে দুর্গন্ধ এতটাই বিকট যে আশপাশ দিয়ে চলাচল কঠিন। নির্ধারিত স্থান ছাপিয়ে ট্যানারির মূল রাস্তার দুপাশেও বর্জ্যরে স্তূপ গড়ে উঠেছে। বর্ষার এই সময় বৃষ্টিতে ধুয়ে ট্যানারির সেই কঠিন বর্জ্য নদীতে পড়ছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পোলট্রি ফিড কারখানায় এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ধলেশ্বরী নদীর বুক চিরে বের হচ্ছে তরল সেই দূষিত বর্জ্য। আগে সরাসরি ফেলা হলেও এখন নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ দিয়ে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে মাঝ নদীতে। ট্যানারির কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের জন্য সিইটিপিতে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দুটি ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণের কথা থাকলেও তার কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। শ্রমিক নেতা আবদুর রহিম বলেন, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা একটি স্থান নির্ধারণ করার কথা ছিল, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। তিনি আরো বলেন, পরিবেশবান্ধব সিইটিপি করতে হলে সলিড ওয়েস্ট (কঠিন বর্জ্য) ম্যানেজমেন্ট ও লিকুইড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট দুটোই থাকতে হবে। অথচ এর মধ্যে একটা আছে আরেকটা নেই। যে একটা আছে, সেটাও পুরোপুরি কাজে আসছে না। এর মধ্যেই আগামী কুরবানি ঈদের চামড়া সংরক্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মালিকরা।

বিসিক চামড়া শিল্পনগরী ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম জাহিদ হাসান, এনডিসি, পিএসসি ভোরের কাগজকে বলেন, চামড়া শিল্পনগরী বর্তমানে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে, টুকটাক যা সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে কাজ করছে বিসিক। তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে, যারা সার্বক্ষণিক সম্পূর্ণ কার্যক্রম তদারকি করবে। যাতে দ্রুত সংকট নিরসন সম্ভব হয়। এছাড়া ঈদের দিন ও পরের দিনগুলোতে সরাসরি ট্যানারিতে চলে আসা বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবস্থাপনায় যেন কোনো সমস্য তৈরি না হয় সেজন্য আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সবকিছু মিলিয়ে সমস্যা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি সংকট উত্তরণে বিসিকের পক্ষ থেকে যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

সাভার চামড়া শিল্পনগরীর (বিসিক) প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, দুটি অস্থায়ী ডাম্পিং ইয়ার্ড করা হয়েছে। আশা করি, এ বছর কুরবানির মৌসুমে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। পরবর্তী সময়ে যথাযথ পরিকল্পনা করে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App