×

জাতীয়

উজ্জীবিত দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ০৮:৪৭ এএম

উজ্জীবিত দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী

প্রতীকী ছবি।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর থেকেই সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে তালেবান যোদ্ধারা। এরই মধ্যে তারা দখলে নিয়েছে দেশটির বিশাল এলাকা। তালেবানরা শিগগিরই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে, এমন আশঙ্কা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। আফগানিস্তানে তালেবানদের সাফল্যে বিশ্বজুড়ে নতুন করে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এই প্রেক্ষাপটে উজ্জীবিত আমাদের দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীও। সন্ত্রাসবাদীদের ইসলামী শাসন কায়েম ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুপ্ত বাসনা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, জঙ্গিদের তৎপর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে আর কখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবি ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামে পরিচিতি পাওয়া দেশীয় অনেক জঙ্গি ধরা পড়লেও গোপনে তৎপর অনেকে। তারাই এখন নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনতে পারে বলে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। বিশেষ করে জঙ্গিদের পাশাপাশি মিয়নমারের বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গারাও এই পথ ধরতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বড় বড় সব শহর দখলে নিয়েছে তালেবান। এরই মধ্যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি বাস্তবে গৃহযুদ্ধ হয়, তাহলে তালেবান বিজয় উল্লাস করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ধারণা থেকেই যারা জঙ্গিপুষ্ট, তারা উৎসাহী হচ্ছে। হওয়ার কথাও। কেননা ন্যাটোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর তালেবানরা সফলতা পেয়েছে, যা আমাদের দেশে জঙ্গিদের জন্য বড় উৎসাহের জায়গা হয়ে দাঁড়াবে। এর সঙ্গে উদ্বেগের কারণ হবে রোহিঙ্গারাও। প্রায় সব রোহিঙ্গা যুবক হতাশাগ্রস্ত হওয়ায় তাদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর অশঙ্কা আগে থেকেই রয়েছে। তালেবানের উত্থান তাদের মধ্যেও জোয়ার সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে আফগানিস্তান অনুসারী কোনো জঙ্গি নেই। জঙ্গি দমনে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক দূর এগিয়েছে। জঙ্গিদের যে কোনো ধরনের তৎপরতা শুরুর আগেই ভেস্তে যাচ্ছে। গোয়েন্দা তৎপরতা ও প্রযুক্তির সহায়তায় তারা আটক হচ্ছে। সবগুলো সংস্থা সমন্বিতভাবে ও নিজেদের মতো করে এ নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, দেশে জঙ্গিদের তৎপর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সব সময় গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

আফগানিস্তানে তালেবানদের তৎপরতায় এদেশের জঙ্গিদের সরব হওয়ার কোনো ধরনের সক্ষমতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. ইমরান হোসেন বলেছেন, জঙ্গিবাদ দমনে সিটিটিসিসহ বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেক বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন। সব ধরনের আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে আমরা নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের ফলে যদি আমাদের দেশে কোনো প্রভাব পড়ে, অবশ্যই সেটি আমরা বুঝতে পারব। যে-ই জঙ্গিবাদে জড়াবে বা নাশকতার চেষ্টা করবে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশে আর কখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এখন আর আগের দিন নেই, বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে ফেলবে। জঙ্গিরা যেভাবেই নাশকতার চেষ্টা করুক, আমরা তাদেরকে আইনের আওতায় আনবই।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে তালেবান উত্থান ঘটে। এরপর থেকেই তারা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে আসছে। মার্কিন বাহিনীর সঙ্গেও তাদের লড়াই চলছে। এর মধ্যে ন্যাটো প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হলে তালেবানরা রাজধানী কাবুলসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে তাদের আস্ফালন দেখে তালেবান অনুসারী জঙ্গিরা মানসিক শক্তি লাভ করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসবাদ বৈশ্বিক নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেই হিসেবে আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের কারণে আমাদের দেশের জঙ্গিবাদেও প্রভাব পড়বে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা না থাকায় আবার জঙ্গি তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। এর আগে আফগানিস্তানফেরত অনেককে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। অনেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বা গিয়েছেও। এ অবস্থায় তালেবান যদি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাহলে বাংলাদেশে থাকা জঙ্গিরা অনুপ্রাণিত হবে। ফলে তালেবানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নতুন নতুন হামলার পরিকল্পনা করতে পারে জঙ্গিরা। যেমন নব্য জেএমবির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেশ কিছু হামলা চালিয়েছে। আফগানিস্তানে জঙ্গিবাদের অবস্থা যদি সিরিয়ার মতো হয়, তাহলে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের জন্য আরো হুমকি হিসেবে দেখা দেবে।

তালেবানের উত্থানে রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তালেবান উগ্রপন্থী হলেও আলাদা ভাবমূর্তি নিয়ে চলে। ক্ষমতা দেখিয়ে বিভিন্ন শহর ও এলাকা দখলে নিচ্ছে। এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রোহিঙ্গাদের কেউ জঙ্গিবাদে জড়াবে না বা জড়ায়নি, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। সব মিলিয়ে তালেবানের যত বেশি উত্থান হবে, বাংলাদেশকে তত বেশি সতর্ক হতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থার কাছে খবর রয়েছে, তালেবানদের দেখে দেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ফের আফগানিস্তানমুখী হতে পারে। আনসার আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের সদস্যদের আফগানিস্তান যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল সেখানে মার্কিন বোমা হামলায় নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশিও ছিল। তারা ইসলামিক স্টেট (আইস) সদস্য। জিবিইউ-৪৩ বা ‘মাদার অব অল বম্বস’ নামে এ বোমা হামলার ঘটনায় নিহতদের তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক ছিলেন। তখন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রাদমানিশ জানিয়েছেন, হামলায় নিহত জঙ্গিদের অধিকাংশই পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের।

জানা গেছে, আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবক। যার একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক। সেই আফগানফেরত যোদ্ধাদের উদ্যোগেই ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) কার্যত আত্মপ্রকাশ করে। আফগানফেরত মুজাহিদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হয়। আফগান যুদ্ধের সময় তারা গেরিলা যুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। হুজিকে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিকে এক দফা ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হুজি আবার নাম পাল্টে ইসলামী গণ-আন্দোলন বা আইডিপি (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি) নামে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করে। তারা পল্টনে দলীয় কার্যালয় খোলে এবং নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে। এর মধ্যে তাদের তৎপরতা খোলাসা হলে একে একে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে হুজির প্রধান আবদুস সালাম, একাংশের প্রধান মুফতি হান্নান (পরে ফাঁসি হয়েছে), শেখ ফরিদ, মাওলানা ইয়াহিয়াসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা। তবে দেশের বাইরে অবস্থান করে এখনো হুজি সদস্যদের উৎসাহ ও মদত দিয়ে যাচ্ছেন নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি শহীদুল ইসলাম, মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা আবু বক্কর। আট বছর ধরে আনসার আল ইসলাম নামে হুজির সদস্যরা সক্রিয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসিম উদ্দিন রাহমানী বিভিন্ন সময় পরামর্শ করে আসছিলেন। এরপর তারই একনিষ্ঠ অনুসারী মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

একাধিক সূত্রমতে, কয়েক বছর ধরে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা বিভিন্নভাবে গোপনে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছিল। ৪ মার্চ আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফ মিঠু ওরফে হাসান, সংগঠনের ‘শেখ’ সোহান শাদ ওরফে বারা আবদুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবিরকে গ্রেপ্তারের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে। গ্রেপ্তারকৃত মাইনুল ঢাকায় মাদ্রাসা পরিচালনার নামে শিশুদের ‘জিহাদি’ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। এছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক নাশকতায় আফগানফেরত যোদ্ধাদের ‘মদত’ ছিল। তাদের একজন সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক গুরু মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী। গুনবী তার অনুসারীদের বেশির ভাগ সময়ই জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আফগানিস্তানের বিষয়টি তুলে ধরেন। ঘনিষ্ঠদের তিনি আফগানিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিভিন্ন সময়।

জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা দীর্ঘদিন ধরে চুপচাপ থাকলেও বর্তমানে আফগান পরিস্থিতি তাদের উজ্জীবিত করে তুলেছে। এরই মধ্যে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে। এমনই একটি ক্লোজ গ্রুপের নাম ‘সায়েন্স প্রজেক্ট’। এ চ্যাট গ্রুপের ১০ তরুণের মধ্যে তিনজন আফগানিস্তান যাত্রা করেছে। তাদের দুজনের আফগানিস্তানে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। এ দুজন হলো কুমিল্লার আবদুর রাজ্জাক ও সিলেটের শিব্বির আহমেদ। রাজ্জাক সিলেটে একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাত। তার সন্ধান চেয়ে ভাই সালমান খান ২৫ মার্চ সিলেটের কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। আর রবিউল নামে নোয়াখালীর আরেক তরুণ আফগানিস্তানের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছে। তবে গত ৮ মে ওই গ্রুপের চারজনকে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করে। তারা আফগানিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানা গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App