×

সম্পাদকের কলাম

করোনায় নিজেকে কুরবান দেয়ার জন্য প্রস্তুত!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২১, ০৬:১৯ পিএম

ত্যাগের মহিমা নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে ঈদুল আজহা। নানা দেশে এই ঈদুল আজহার নাম আবার ভিন্ন। ভারত ও পাকিস্তানের বলা হয় বকরি ঈদ। মিসর এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবশ্য এই দিনটি ঈদ আল বাকরা নামে পরিচিত। শিয়া অধ্যুষিত ইরানে এই দিনের নাম ঈদ ই কুরবান। পৃথিবীর সবচেয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অবশ্য বলা হয় ঈদুল আদহা। যাই হোক, যে নামেই বলি না কেন বিশ্বকে ওলট-পালট করে দেয়া করোনা পরিস্থিতির মধ্যে নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে এই ঈদ। করোনার থাবায় প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন ঈদের আনন্দ অবশ্য অনেকখানি মলিন হওয়ার কথা। কিন্তু রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেট কিংবা মৌচাক মার্কেটে গেলে আপনি এই মলিনতার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাবেন না। করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় মানুষ ব্যস্ত কেনাকাটায়। অন্যদিকে আরেক দল ব্যস্ত ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে গ্রামে ফেরা নিয়ে। লকডাউন শিথিল করায় মানুষের মধ্যে যেন একটা কেনাকাটার উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। ঢাকা শহরকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই দেশে করোনা ভাইরাস বলতে কিছু আছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসনমন্ত্রী আবার হুমকি দিয়েছেন ‘আগামী ২৩ তারিখ থেকে কঠোরতম লকডাউন পালিত হবে। এবার সব শিল্প কারখানাও বন্ধ থাকবে।’ এর আগেও তিনি নানা রকম ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে মন্ত্রীদের এ রকম ঘোষণা নিয়ে তেমন উৎকণ্ঠা কারো মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। তাই দেশবাসী ব্যস্ত কেনাকাটায়। বাজারে, মার্কেটে, গরুর হাটে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। সংক্রমণের তুঙ্গ সময়ে করোনা ভাইরাসের মতো এ রকম একটি ভয়ংকর রোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর এ রকম নজির পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। এমনও হতে পারে, এ রকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে করোনা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েও যেতে পারে।

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা এত তীব্র যে, হাসপাতালে কোনো সিট খালি নেই। ডাক্তাররা আপ্রাণ লড়ছেন মানুষকে বাঁচানোর জন্য। একটু চিকিৎসার আশায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকামুখী হচ্ছে অনেক রোগী। অনেকেই মারা যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে। ঢাকায় আর রোগী নেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। তারপরও অনেকে আসছে। একটু উন্নত চিকিৎসার আশায়। কিন্তু রাজধানীর চিকিৎসা ব্যবস্থা বাইরের আর কাউকে ধারণ করতে পারছে না। চিকিৎসা ব্যবস্থা এত নাজুক হওয়ার পরও কিন্তু গরুর বাজারে ভিড়ের কমতি নেই। স্বাস্থ্যবিধিরও বালাই নেই, মুখে মাস্কের দেখাও নেই। মহান আল্লাহতালা হযরত ইব্রাহিমকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার প্রিয় একটি বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানি দেয়ার জন্য। মানুষ মনে হয় জেনে-বুঝেই নিজেকে কুরবান দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। অথচ ধর্মের বিধান আছে প্রতীকী হিসেবে একটি পশুকে কুরবানি দেয়ার। কিন্তু জনগণকে জান কুরবান করে দেয়ার এই অসাধারণ সুযোগটা করে দিয়েছে সরকার নিজেই। যেদিন দেশের সর্বোচ্চ মৃত্যু, সর্বোচ্চ সংক্রমণ সেদিনই লকডাউন তুলে দেয়ার ঘোষণা এলো। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের দিকে ছুটতে শুরু করল মানুষ। গ্রামগঞ্জে আগে থেকেই ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এই করোনা। বিশেষ করে ছোট ছোট শহর এবং সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। ঢাকাবাসী বীরদর্পে ছুটছে এখন সে গ্রামগুলোতে। করোনার কি সাধ্য আছে গ্রামে যাওয়া ঠেকানোর। সব বিশেষজ্ঞের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে লকডাউন শিথিল করে দেয়া হলো। খুলে দেয়া হলো সবকিছু। রাজধানী আবার স্বাভাবিক। ঢাকার মার্কেটগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই শহরের কোনো হাসপাতালে এখন একটা আইসিইউর সিটও খালি নেই।

এতদিন গ্রামের লোক বলত করোনা শহরের রোগ, গ্রামে ছড়ায় না। এই ধারণা তছনছ করে ভেঙে দিয়েছে করোনার গ্রামমুখী যাত্রা শুরু হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। ভারত সীমান্তঘেঁষা এই জেলাটি ডেল্টা ভাইরাসে ছেয়ে গিয়েছিল রোজার ঈদের সময়। সেটা ছড়াতে ছড়াতে এখন বরিশাল, খুলনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। জেলা-উপজেলার ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এই ভয়ংকর করোনা রোগের কারণে। গ্রামে ডেল্টায় আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটল, যার কোনো হিসাবও নেই সরকারের খাতায়। ফলে প্রতিদিন দুই শতাধিক মানুষের যে মৃত্যুর সংখ্যা, তা সত্যের কাছাকাছি কিনা সে প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু এত কিছুর পরও গ্রামে যাওয়া বন্ধ হলো না। শহরের মানুষ গ্রামে যাচ্ছে ভাইরাস নিয়ে। গ্রাম থেকে ভাইরাসসহ গরুর মালিকরা গরুর গাড়ি নিয়ে আসছে ঢাকা শহরে। জেনে-বুঝে করোনা আক্রান্ত হয়ে নিজেদের আত্মত্যাগ করার এ রকম অপার মহিমা আর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুরবানির ঈদের পরে সংক্রমণের হার এতই ব্যাপক হবে যে, বাংলাদেশের এই দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতকে এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এখন কর্নার সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল হয়েছে ইন্দোনেশিয়া। চিকিৎসা না পেয়ে অকাতরে মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে সেখানে। সংক্রমণের হার এতই ব্যাপক হবে যে, মানুষকে হয়তো চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় মরতে হবে। স্পেন, ইতালির মতো উন্নত দেশগুলোকেও গত বছর এ রকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। গত সপ্তাহে বগুড়া থেকে আসা এক অশীতিপর বৃদ্ধ আব্দুস সোবাহান ঢাকার কোনো হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে কাতরাতে কাতরাতে মারা গেলেন। একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত সেই দৃশ্য এতই মর্মস্পর্শী যে, যে কোনো মানুষের হৃদয়কে কষ্টে ভরে তুলবে। কিন্তু তারপরও করোনা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই এই নগরবাসীর মধ্যে। করোনাও আছে, আবার করোনাকে উপেক্ষা করার প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনাও আমাদের মধ্যে আছে। প্রতিদিন গণমাধ্যমে সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যাও যেমন প্রচারিত হচ্ছে, একই সঙ্গে প্রচারিত হচ্ছে গরুর বাজার আর মার্কেটে ব্যাপক জনসমাগমের খবর। জীবন নিয়ে এ রকম বিপরীতমুখী চিত্র আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন কুরবানির বাজারে নানা রকম গরুর সমাহার। বড়, ছোট, মাঝারি নানা রকমের গরুর নামের বাহার নানা রকম। অনলাইনে কি সুন্দর গরুর চেহারা! গরুর সাজগোজের বাহার আর দাম শুনে মনে হয় কেন গরু হয়ে জন্মগ্রহণ করলাম না! বিভিন্ন সংস্থা হোম ডেলিভারি সার্ভিসও দিচ্ছে। কিন্তু বাজার থেকে দরদাম করে গরু কেনা ও গরুর দড়ি ধরে হাঁটতে হাঁটতে, অসংখ্য মানুষকে গরুর দাম বলতে বলতে বাড়ি ফেরার আনন্দই নাকি আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত গরুর লেজে মোচড় দিয়ে তাকে চাঙ্গা করার ব্যাপারটিতেও অনেক আনন্দ আছে। করোনা আছে তো কি হয়েছে? নিজেকে তো এ রকম একটি আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা যায় না! ঈদুল আজহার ধর্মীয় উদযাপনটি ত্যাগের, তাই বলে আনন্দ করা যাবে না, এ রকম তো কোনো বিধান নেই। তাই এই উদযাপনের প্রতিযোগিতায় বড় হয়ে ওঠে, কার চাইতে কে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনতে পারে। এই দামের প্রতিযোগিতার মধ্যেও নাকি এক ধরনের আনন্দ আছে!

নাদুস-নুদুস বিশাল সাইজের গরুর পাশাপাশি ইদানীং বাজারে মিনিয়েচার গরুও পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী গাবতলী বাজারে কুষ্টিয়া থেকে আনা সিন্ধি জাতের ৩৬ ইঞ্চি লম্বা একটা গরুর দাম হাঁকছেন ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এত ছোট গরু কুরবানির উপযুক্ত কিনা প্রশ্ন করতেই মালিক গরুর চারটি দাঁত দেখিয়ে দিলেন! গাবতলীর গরুর বাজারে একটা উটও উঠেছে। বিক্রেতা দাম বলতে বলতে হয়রান। বিরক্ত হয়ে এই উট বিক্রেতা বললেন, কেউ কিনছে না। শুধু দাম জানতে চাই। ইতোমধ্যে অনলাইনে চরের গরুর বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো এই গরুর দাম খামারি গরুর চাইতে নাকি বেশি। এই গরুর মাংসে ভিটামিন ডি যে বেশি থাকবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ফলে দাম একটু বেশি হতেই পারে। যাই হোক, কুরবানি ঈদের পরে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি আমাদের কী ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে যাবে, সেটা দেখার জন্য হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে কয়েক সপ্তাহ।

লেখাটা শেষ করব গরুর দুটি গল্প বলে। পরীক্ষার খাতায় গরুর রচনা লিখল দুই ছাত্র। শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, তোদের দুজনের গরুর রচনা একই রকম হলো কী করে? সঙ্গে সঙ্গে এক ছাত্র উত্তর দিল, হবে না স্যার, আমরা তো দুজন একই গরুর দিকে তাকিয়ে রচনাটা লিখেছি। উত্তর শুনে একটু ইতস্তত হয়ে শিক্ষক আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলতো, সবচেয়ে চালাক পশুর নাম কী? আরেক ছাত্র উত্তর দিল, গরু। উত্তর শুনে ক্ষুব্ধ শিক্ষকের প্রশ্ন, গরু কী করে চালাক প্রাণী হয় রে? ছাত্রের উত্তর : স্যার, আপনিই তো পড়ালেন, অতি চালাকের গলায় দড়ি। আমরা তো গরুর গলাতেই দড়ি দেখি। তাহলে গরুই হবে সবচেয়ে চালাক প্রাণী। শিক্ষক আর এই বিষয় নিয়ে খুব বেশি এগোলেন না।

স্কুলপড়ূয়া কন্যা বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা বাবা বলতো, এই গো হারা, গো বেচারা যে আমরা বলি এই ‘গো’ জিনিসটা কী? বাবা উত্তর দিলেন, এই ‘গো’ হচ্ছে গরু। এমন সময় স্ত্রী রান্নাঘর থেকে ডেকে উঠলেন, ও গো, একটু এদিকে এসো তো?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App