×

সারাদেশ

নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ আগুন, মেয়ে ফিরলেও ফেরেনি মা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১, ০৮:৩৯ এএম

নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ আগুন, মেয়ে ফিরলেও ফেরেনি মা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কারখানাটিতে আগুনে পুড়ে নিহতদের পরিবারের আহাজারি। ছবি: সংগৃহীত

আপনজনদের সন্ধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গের সামনে যখন প্রচণ্ড ভিড় সেসময় দেখা যায় এক কোণে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে। মাস্কে ঢাকা চেহারা দেখা না গেলেও তার দুচোখ বেয়ে ঝরে যাওয়া অশ্রুই বলছিল অনেক কিছু। তার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর কথা বলতে চাইলে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, তার নাম চম্পা আক্তার। ১৭ বছর বয়সি এ কিশোরী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় তলায় নুডলস প্যাকিং সেকশনে কাজ করত। আর মা মীনা খাতুন (৪০) কাজ করতেন ভবনের চার তলার নসিলা সেকশনে। ভয়াবহ আগুন লাগার কিছু আগেই এক সহকর্মীর কার্ড অসুবিধার অভিযোগ নিয়ে নিচ তলায় টাইম সেকশনে আসে সে। আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। কপাল ভালো হওয়ায় সে বেরুতে পারলেও তার মা মীনা খাতুন চার তলায় আটকা পড়েন। চম্পা ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে, আগুনে চার তলার কেউই বাঁচেনি শুনেছি। আমি ফিরলেও আমার মা ফেরেনি।

তবে চম্পা ফিরলেও মাত্র আট দিন আগে ওই ফ্যাক্টরিতে কাজে যোগ দেয়া ১৪ বছর বয়সি কিশোরী কম্পা রানীর আর ফেরা হয়নি। সেও পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে। চম্পার মতো কম্পার বাবা পরভা চন্দ্র বর্মণও আহাজারি করছিলেন মেয়ের জন্য। শুধু এই দুই পরিবারই নয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে কয়লা হওয়া ৪৯ জনের লাশের স্বজনদের আহাজারিতে এখন ভারি হয়ে উঠেছে ঢামেক মর্গের পরিবেশ।

শুক্রবার ঢামেক হাসপাতাল মর্গে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের সময় কারখানা থেকে বেরুতে না পারা স্বজনদের ছবি হাতে নিয়ে ঘুরছেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের সঙ্গে কথা বললে দেখা যায় ওই ফ্যাক্টরিতে কাজ করা অধিকাংশই শিশু। কেউ নসিলা নুডলস, চকলেট ও জুস সেকশনে কাজ করত। তাদের অধিকাংশেরই বেতন ও ওভারটাইম মিলিয়ে ৪-৮ হাজার টাকা হয়েছিল। অনেকে করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় কাজে যোগ দিয়েছিল। আবার কেউ পরিবারের সহায়তার জন্য কাজ করছিল।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারি গতকাল মর্গের সামনে এ প্রতিবেদককে জানান, এ ঘটনায় তাকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। আর লাশের পরিচয় শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের সময় দাফন-কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। আর আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হবে।

সেখানে কর্মরত অধিকাংশই শিশু এমন প্রশ্নের উত্তরে এ কর্মকর্তা বলেন, এমন অভিযোগ শুনেছি। যদিও শ্রম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়টি দেখার কথা। তবে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চলার সময় সব বিষয়ই উঠে আসবে। শুক্রবার মর্গের সামনে দেখা মেলে রিকশাচালক কবীর হোসেনের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ওই ফ্যাক্টরিতে কাজ করত তার ১৭ বছর বয়সি কিশোর ছেলে রাকিব হোসেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিল সে। অগ্নিকাণ্ডে আটকে যায় ছেলে আমার।

তিনি কেঁদে বলেন, আমার সন্তানের লাশটুকু শুধু চাই। শুধু রাকিব নয় তার ১২ বছর বয়সি চাচাতো ভাই মো. হাসনাইনও চার তলায় কাজ করছিল। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় কাজে যোগ দেয় সে। এখন শুধু তার লাশটুকু ফেরত চায় বড় বোন মোসাম্মত তানিয়া।

ঢামেক মর্গে নারায়ণগঞ্জ সদরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাস চন্দ্র সাহা গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, রূপগঞ্জের কারখানাটি থেকে ৪৯টি লাশ উদ্ধারের পর মর্গে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি লাশেরই ময়নাতদন্ত করা হবে। আর লাশগুলোর অধিকাংশই এমনভাবে পুড়েছে যে চেনার কোনো উপায় নেই। তাই ময়নাতদন্তের সময়ই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এরপর লাশের দাবিদারদের সঙ্গে তা ক্রসম্যাচ করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে। ডিএনএ স্যাম্পল নেয়ার কাজটি করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সিআইডির সিনিয়র ডিএনএ এনালাইসিস্ট আশ্রাফুল আলম বলেন, আমরা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছি। মূলত স্বজনদের রক্তের নমুনা ও সোয়াপ নেয়া হচ্ছে। তবে প্রয়োজনে আরো অন্যান্য স্যাম্পলও নেয়া হবে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৮ জনের পরিবারের ডিএনএ স্যাম্পল নেয়া শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App