×

সম্পাদকের কলাম

খেলা দক্ষিণ আমেরিকায়, উত্তেজনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১, ১০:৪৩ পিএম

হুজুগে জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম আছে। কিন্তু কখনো কখনো সেই হুজুগ যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, তখন সেটাকে শুধু হুজুগ বললে বেচারা হুজুগেরও অভিমানে লাগতে পারে। খেলা হবে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ আমেরিকায় কিন্তু সমস্ত উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই নিয়ে হাস্যরসাত্মক রিপোর্ট হচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার খেলার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কী অবস্থা হয় সেটা দেখার জন্য। ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। কঠোর নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। যেসব এলাকা সংঘাতপূর্ণ বলে চিহ্নিত সেখানে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। উগ্র ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বাড়ির সামনে পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। বাইরে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখা ও খেলা শেষ হওয়ার পর বিজয় মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভাবা যায়, পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী রকম উত্তেজনা বিরাজ করছে? অনেকেই হয়তো খেলার ফলাফল দেখার পরে ফলাফল নিয়ে আনন্দ-ফূর্তি করার আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে তাকিয়ে থাকবেন সেখানে কী প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্য। হয়তো খেলা শেষ হওয়ার পর হাতে হাত মিলিয়ে মেসি ও নেইমার মাঠ থেকে বেরিয়ে যাবেন। হয়তো কফি খেতে বসবেন খেলার পরের সময়টা আনন্দ উপভোগের মধ্য দিয়ে কাটাতে। আর সেই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উত্তেজিত দক্ষিণ আমেরিকার দুটি দেশের দুই সমর্থক দল লাঠিসোটা, টেটা-বল্লম নিয়ে লিপ্ত হয়ে যাবে সংঘাতে। হায়রে বাঙালি!

এর আগে খেলা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে আর্জেন্টিনার এক সমর্থকের চাচাকে ধানক্ষেতে একাকী পেয়ে বেধড়ক পিটিয়েছে ব্রাজিলের সমর্থকরা। এরপর এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা প্রস্তুতি নিয়েছিল ব্রাজিলের সমর্থকদের বাসায় হামলার জন্য। পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে আর সেটা সম্ভব হয়নি। উত্তেজনা আরো চরমে উঠেছে যখন শেষ পর্যন্ত কোপা আমেরিকার ফাইনালটি হচ্ছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে। পুরো এলাকাবাসী দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন খেলা দেখার জন্য এবং নিজ নিজ অস্ত্রে শান দিচ্ছে সম্ভাব্য মারামারি মোকাবিলা করার জন্য। অনেকেই বলছেন, এই খেলা চলাকালে তিনজন ব্যক্তি চরম টেনশনে থাকবেন। এদের একজন ব্রাজিলের কোচ, আরেকজন আর্জেন্টিনার কোচ এবং অপরজন হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশের এসপি। বেচারা পুলিশের এসপি! তাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানোর কৌশল নিয়ে চিন্তা করতে করতে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী ঘটে। পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকমও হতে পারে। তবে ইতোমধ্যে যা ঘটে গেছে তা সত্যিই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। করোনার এই বিধ্বংসী সময়ে টানা লকডাউনে মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী দেশের মানুষের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি করেছে, তাই বা কম গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন। ফুটবল খেলার উত্তেজনায় বাংলাদেশে যা ঘটে, পৃথিবীর আর কোথাও এরকম ঘটনাবলি নজিরবিহীন। সম্প্রতি ব্রাজিলের পতাকা উড়াতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে এক বালক। গত বিশ্বকাপের সময় নিজের শেষ সম্বল সামান্য জায়গা যেটুকু ছিল তা বিক্রি করে ৫ কিলোমিটার লম্বা জার্মানির পতাকা তৈরি করছিল মাগুরার এক দরিদ্র কৃষক। ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত তাকে উৎসাহ দিতে মাগুরা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কোনো কোনো বাড়ি পুরোটাই ব্রাজিলের পতাকা অথবা আর্জেন্টিনার পতাকার মতো দেখতে। মিরপুরের দিকে গেলে বা ঢাকার বাইরের কিছুকিছু গ্রাম দেখলে মনে হবে আপনি হয়তো আর্জেন্টিনায় আছেন অথবা ব্রাজিলে আছেন। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার পত্রিকায় এ নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। গত বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে ব্রাজিল থেকে একটা টিম এসে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের ব্রাজিল প্রেমের ওপরে একটা ডকুমেন্টারি করে নিয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ভিন্ন দেশের পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে যে পরিমাণ উৎসাহ কিন্তু নিজের দেশের পতাকা উড়ানোর ব্যাপারে তেমন উৎসাহ খুব একটা দেখা যায় না। এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে উৎসাহের ব্যাপারে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। ১৯৯৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিল ক্লিনটনের সমর্থনে চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিল ক্লিনটন সাপোর্টার্স ক্লাব হয়েছিল। তারা চাঁদা তুলে ব্যাপক খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছে এবং ক্লিনটনের বিজয় কামনা করে বিশাল মিছিল করেছে। এই মিছিলের কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার লম্বা যানজট তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এ নিয়ে মজার মজার খবর ছাপা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সভায় যখন এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলাম, তারা বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে ছিল এবং যে প্রশ্নটা করেছিল, তার কোনো উত্তর দিতে পারিনি। প্রশ্নটা ছিল, ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী বিল ক্লিনটনের প্রতি পটিয়ার জনগণের এই বিশেষ সমর্থনের কারণ কী? আমার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। কারণ এই প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে, সেটা আমার জানা ছিল না। এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা কেন- এই প্রশ্নের উত্তরও হয়তো কারো জানা নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জায়গাটি বড় অদ্ভুত। নামের মধ্যে জাত-কুল শিরোমনি ব্রাহ্মণ থাকলেও কাজে-কামে সেই সুনাম তারা রক্ষা করতে পারেন না। কিছু দিন আগে এই জেলার সরাইলের এক বাজারে গরুর মাংস বিক্রির সময় ওজনে কম দেয়ার অভিযোগে দুই গ্রামের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটেছে। আহত প্রায় শতাধিক। এছাড়াও কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ না থাকলেও দুই গ্রামবাসী বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সম্প্রতি এই অঞ্চলের কিছু মানুষ এ ধরনের সংঘর্ষে আর কোনদিন লিপ্ত হবে না বলে মুচলেকা দিয়ে তাদের এটা টেটা বল্লম থানায় জমা দিয়েছে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এ ধরনের সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার মনস্তত্ত্ব নিয়ে সামাজিক গবেষণা হতে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে কাজটি ঘটে গেছে সেটি হল, ২৬শে মার্চের পরে হেফাজতের তাণ্ডব। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে হামলা চালিয়ে পৌর মিলনায়তন, পাবলিক লাইব্রেরী, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁন একাডেমি সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, সেই বর্বরতার নজির মেলা ভার। অথচ সেই শহরের জনগোষ্ঠী আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলের চরম ভক্ত। কোপা আমেরিকার দুটি দেশের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে চরম উত্তেজিত। এসব কারণে মনে হয় যেকোনো বিষয়ে উত্তেজিত হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিবাসীদের বিশেষ গুণাবলী রয়েছে । ইউরোপীয় ফুটবলে সবচেয়ে উগ্র সমর্থকদের দেশ হিসেবে দুর্নাম রয়েছে ইংল্যান্ডের। এর আগে ইংল্যান্ড ডেনমার্ক খেলা শেষ হওয়ার পর ইংল্যান্ড সমর্থকদের হাতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এখনো ইউরোপীয় কাপের খেলার সময় ইংল্যান্ডের খেলা থাকলে পুলিশ অনেক সতর্ক থাকে। অথচ এই ব্রিটিশরাই সারা পৃথিবীকে সভ্যতা শেখায়।

যাই হোক, ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা হবে আর বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে এটাই প্রত্যাশা। প্রতিবেশী এ দুটি দেশে খেলা নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও দেশ দুটি আছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই। এমনকি কখনো কখনো আন্তর্জাতিক সংকটের আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছে ব্রাজিল। বিশেষ করে সত্তর দশকের শেষের দিকে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা যখন আর্জেন্টিনার এই দ্বীপে হামলা চালায়, তখন ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সমর্থনে পাশে দাঁড়িয়েছিল। ব্রাজিলের পেলে কিংবা আর্জেন্টিনার মারাদোনা অথবা নেইমার কিংবা মেসির খেলা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হতে পারে কিন্তু এই নিয়ে সংঘাত করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এমন অনেক অমীমাংসিত বিষয়ে রয়ে গেছে, যার এখনও সুরাহা হয়নি।

এর আগে নাসিরনগরে দরিদ্র জেলে পরিবারের সন্তান রসরাজের এক ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর যেভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তার সুরাহা এখনো হয়নি। রসরাজ দাসকে এখনো খুঁজেও পাওয়া যায়নি। সংস্কৃতির পীঠস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিভাবে মৌলবাদীদের দখলে চলে গেল সেই প্রশ্নেরও মীমাংসা হয়নি। এমনকি গত ২৬ শে মার্চের পরে যে নাটকীয় তাণ্ডব হয়েছে সেই ঘটনার কোনো সঠিক তদন্তও হয়নি। হয়তো তাদের কাছে মনে হতে পারে, এসব বিষয় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া। এখন কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা দেখবেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সংঘাত দেখবেন-সে পছন্দটা একেবারেই আপনার নিজের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App