×

জাতীয়

লকডাউনের ৭ দিনে অর্জন কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২১, ০৮:৩১ এএম

লকডাউনের ৭ দিনে অর্জন কী

লকডাউনে মোটর সাইকেল থামিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন সেনা সদস্যরা।

প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে দেশে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে করোনার সংক্রমণ। শনাক্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেখে মুখে কিছুটা হা-হুতাশ করলেও বেশির ভাগ মানুষের আচরণ ও চলাফেরা সেই আগের মতোই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মানুষকে ঘরবন্দি রাখতে যত পদ্ধতিই সরকার নিক না কেন, এর কোনোটাতেই নেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া। অন্য দিকে সরকার প্রজ্ঞাপনে যতটা কঠোর হওয়ার কথা বলেছে, বাস্তবে তার খুব একটা দেখা মিলছে না। অথচ জুলাইয়ে সংক্রমণ বাড়ার পূর্বাভাস মার্চেই দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই পূর্বাভাসই এখন সত্যি হয়ে চোখ রাঙাচ্ছে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির।

এদিকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে ১ জুলাই থেকে সারাদেশে শুরু হওয়া সর্বাত্মক লকডাউনের সাত দিন এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। প্রথম দুই-তিন দিন লোকজন অপ্রয়োজনে ঘর থেকে খুব একটা বের না হলেও তৃতীয় দিন থেকে বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। পঞ্চম দিনে ব্যাংক-বীমা-শেয়ারবাজার চালু হয়ে যাওয়ায় রাজধানীতে লকডাউনের খুব একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। গণপরিবহন বন্ধ থাকা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টগুলোয় কড়াকড়ি ছাড়া জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক। কাঁচাবাজারে ভিড় অনেকটা আগের মতোই, অলিগলিতেও চলছে আড্ডাবাজি। ফলে এই লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে করোনায় ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ৫ জুলাই ১৬৪ জনের এবং ৬ জুলাই ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ হাজার ৬৩৯টি নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ১৬২ জন। আগের দিন ৬ জুলাই ১১ হাজার ৫২৫ জন রোগী শনাক্ত হয়, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে চিত্র আমরা দেখছি, সেটি আগের প্রভাবের ফল। সাধারণত মৃত্যুর ওপর প্রভাব দেখতে ২১ দিন এবং সংক্রমণের ওপর প্রভাব দেখতে হলে ১৪ দিন সময় লাগে। তাই এখনকার যে লকডাউন ও বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে, তার প্রভাব দেখতে হলে আমাদের আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

সর্বাত্মক লকডাউনের প্রথম সাত দিন করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কতটা ভ‚মিকা রেখেছে? জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, লকডাউনের প্রকৃত অর্থ আমাদের এখানে এসে বদলে গেছে। লকডাউনের নামে এসব গড়পড়তা কার্যক্রমে করোনার মতো একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। তবে কাজ যে একেবারেই হবে না, তাও নয়। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। মানুষ এখনো করোনার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছে না। অন্তত মানুষের আচরণ সেই কথাই বলে। সব দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয়াটাও ঠিক নয়। মানুষ নিজেই নিজেকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনে ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের চলাচলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার ও আমরা লকডাউন বলছি বটে, কিন্তু আদৌ কি তা হচ্ছে? সরকারের প্রজ্ঞাপনে কাঁচাবাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছে। ঢাকায় যেটুকু কড়াকড়ি আছে, গ্রামে কি তা বাস্তবায়ন হচ্ছে? সংক্রমণ তো গ্রামেও ছড়িয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ নিজে বলছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অর্ধেকই গ্রামের রোগী। এছাড়া আন্তঃজেলা যোগাযোগ হয়তো বন্ধ আছে কিন্তু মানুষের চলাচলতো বন্ধ নেই।

তিনি আরো বলেন, সরকার মানুষকে ঘরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাসাতেও তো মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। সংক্রমণের বিস্তার কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কুরবানির পশুর হাট, ঈদযাত্রা, ঈদ নামাজের পরবর্তী সময়ে হয়তো সংক্রমণের বিস্ফোরণ হতে পারে। এর ফলে কিছু বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটবে। মফস্বল এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো উন্নত নয়। তাই তারা চিকিৎসা পাবে না। কাজেই এ রকম নামকাওয়াস্তে লকডাউন দিয়ে আশানুরূপ ফলাফল আসবে না। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা জরুরি। রোগীদের শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশন এবং ওই পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। তবে বাড়িতে আইসোলেশন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত জনস্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটির (সিলেট বিভাগ) সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, একদিকে দোকান মালিকরা বলছেন, দোকান খুলে দিতে। ব্যবসায়ীরা নানা শর্ত নিয়ে হাজির হচ্ছেন। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে তো মুশকিল। এ অবস্থায় সংক্রমণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে? গতকাল করোনা বুলেটিনে অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামও বলেছেন, দেশের চলমান লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করার ঘটনা ঘটছে। এতে করে রোগীর সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলে আবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

গত কয়েক মাসের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, জানুয়ারিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬২৯ জন। এপ্রিলে সেটি লাখ ছাড়িয়ে যায়। জুনে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জনে থেমে ছিল, আর জুলাইয়ের মাত্র ছয় দিনে ৫৩ হাজার ১৪৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণের উচ্চমুখী এ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা এপ্রিল ও জুনকে ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, এক সপ্তাহ ধরে মৃতের সংখ্যা ১০০-র উপরে রয়েছে। গত এক সপ্তাহের চিত্র যদি আমরা দেখি, ৩০ জুন ১১৫ জন মারা গিয়েছিলেন, ১ জুলাই ১৪৩ জন, ২ জুলাই ১৩২, ৩ জুলাই ১৩৪, ৪ জুলাই ১৫৩, ৫ জুলাই ১৬৪ এবং ৬ জুলাই ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ্বদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি। এর আগে ঢাকা বিভাগের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকত। কিন্তু কিছু দিন ধরে দেখেছি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে মৃত্যুর হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App