×

ফিচার

আইয়ুবের আগমন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৩ এএম

ঢাকায় বিরূপ পরিস্থিতির মুখে আইয়ুব খান। সর্বত্র কালো পতাকা এবং ‘আইয়ুব ফিরে যাও’- পোস্টার। নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া আলোচনায় না বসার ঘোষণা ছাত্রনেতাদের। ঢাকা ছাড়ার সময় আইয়ুব খান বলেন, মামলা প্রত্যাহার সম্ভব নয়।

৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আইয়ুব খান এক বিরূপ পরিবেশের সম্মুখীন হন। সর্বত্র কালো পতাকা দৃশ্যমান এবং আইয়ুব ফিরে যাও- এই পোস্টার দেয়ালে সাঁটানো। ছাত্রনেতারা ঘোষণা করেন যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসা হবে না।

নয় ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠান করে শপথগ্রহণ করে যে, আগরতলা মামলাসহ সমস্ত রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারসহ জরুরি আইন, দেশরক্ষা আইন, নিরাপত্তা আইন প্রভৃতি কালাকানুনে আটক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। সকল কালাকানুন বাতিল করতে হবে। গণআন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিরোধীদলের নেতাদের গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হতে দেয়া হবে না।

গণআন্দোলনের চাপে সরকার ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশরক্ষা আইনে আটক বন্দিদের মুক্তি প্রদান করতে শুরু করে। ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা জেল থেকে ছাড়া পান। ইপিআর ও সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়। ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এবং পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়।

১২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকা থেকে চলে যান। তিনি বলে যান, ‘আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়।’ কিন্তু ঘটনাস্রোত দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। পূর্ব বাংলায় আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানেও তার ছোঁয়া লাগে। জানুয়ারির শেষ দিকে পেশোয়ার, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়।

১৪ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি তথা ‘ডাক’-এর আহ্বানে সারা পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই দিনের ডাকের আহ্বানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সর্বত্র হরতাল পালিত হয়েছিল।

১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আগরতলা মামলার বিচারাধীন আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে অবাঙালি মিলিটারি সিপাইরা গুলি করে হত্যা করে।

[caption id="attachment_284880" align="aligncenter" width="595"] যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম বইটির কভার ফটো[/caption]

সার্জেন্ট জহুরুল হকের জানাজার পরে তার লাশ নিয়ে মিছিল বের হয়। মিছিল ক্রমেই জঙ্গি রূপ ধারণ করে। লোকে স্বভাবতই সন্দেহ করে, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শেখ মুজিবের জীবনও নিরাপদ নয়।

ওই দিন জনতার বিক্ষোভ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। জনতা একপর্যায়ে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ গুলি চালালে জনতা তাদের বন্দুক কেড়ে নেয় এবং মুহূর্তের মধ্যে সারা ঢাকা শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এস এ রহমান যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বাস করছিলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা সে বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিচারপতি এস এ রহমান কোনোক্রমে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। জনতার বিক্ষোভের ধরন দেখে বোঝা যায় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত জনগণ শান্ত হবে না।

১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা শহরে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয় এবং সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এরপর ১৭ তারিখে পুনরায় যে কারফিউ আরোপ করা হয় তা বিরতিহীনভাবে বলবৎ থাকে।

১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অকারণে, ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষমূলকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে বেয়োনেটে চার্জ করে হত্যা করে। এছাড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র ও অধ্যাপক হতাহত হন। ড. জোহাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার খবর ঢাকায় পৌঁছামাত্র রাজধানীতে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়।

১৮ তারিখে রাতেই ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোক সান্ধ্য আইনের পরোয়া না করে রাস্তায় বের হয়ে আসে। প্রথমে কারফিউ ভঙ্গ করে মালিবাগের জনগণ। তারপর সারা ঢাকায় মানুষের ঢল নামে। অজস্র লোক সেদিন মিলিটারির গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স রাস্তা থেকে আহত ব্যক্তিদের অথবা নিহত ব্যক্তির মৃতদেহকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করলে টহলরত সশস্ত্র বাহিনী বাধা প্রদান করে। সামরিক বাহিনীর গাড়ির শব্দ ও অজস্র গোলাগুলির আওয়াজ পরিবেশকে আতঙ্কপূর্ণ করে তোলে।

১৮ ফেব্রুয়ারির পর ঘটনাস্রোত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯ তারিখে সরকার সান্ধ্য আইন বা কারফিউ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর থেকে আইয়ুব সরকার পিছু হটতে থাকে।

আইয়ুব খান ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ‘ডাকের’ অন্যতম নেতা নবাবজাদা নাসরুল্লাহ খানের মাধ্যমে অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক মিলিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের কোনো অর্থ ছিল না। প্রথমে ১৭ ফেব্রুয়ারি এবং তারপর ১৯ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান জামিনে অথবা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ফলে ওই বৈঠক হতে পারেনি।

১৭ ফেব্রুয়ারির পত্রিকাতেই এ সরকারি সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছিল, ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রদেশব্যাপী সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্ররা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২০ তারিখ সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করে। ইতোমধ্যে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

অভূতপূর্ব উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মহান ‘শহীদ দিবস’ উদযাপিত হয়। সরকার বুঝতে পারে যে, গণআন্দোলনকে আর রোধ করা যাবে না। ২২ ফেব্রুয়ারি ৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রেডিওতে ঘোষণা করে তিনি আর পরবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।

আগামীকাল প্রকাশিত হবে ‘আগরতলা মামলা প্রত্যাহার’ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App