×

সারাদেশ

নোয়াখালী আওয়ামী লীগ কমিটির পরিবর্তন নিয়ে জোর জল্পনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২১, ১০:৩২ পিএম

নোয়াখালী আওয়ামী লীগ কমিটির পরিবর্তন নিয়ে জোর জল্পনা

ছবিতে যথাক্রমে খাইরুল আনম চৌধুরী সেলিম, শিহাব উদ্দিন শাহীন শহিদ এবং উল্যাহ খান হোসেল। ফাইল ছবি

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পরিবর্তনের আভাস শুনা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন ও নোয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেলের নাম শুনা যাচ্ছে।

সভাপতি পদে আলোচনায় নিরবতা দেখা গেলেও জেলা জুড়ে সাধারণ সম্পাদক পদে এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন ও শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেলের নাম সরব আলোচনায় রয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি পরিবর্তনের আভাসটি টক অব দি নোয়াখালীতে পরিনত হয়েছে। গত সোমবার (২৮ জুন) নোয়াখালী আওয়ামী লীগের চলমান সংকটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে স্বাক্ষাৎ করেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমের স্বাক্ষাৎতের পর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পরিবর্তনের আভাস প্রকাশ্যে আলোচনায় আসে।

অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্ব-পদে বহাল থাকছেন সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী এমনটাই জানান দিচ্ছেন তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। তার সমর্থকরা বলছেন, একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী আওয়ামী লীগকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাই একরামুল করিম চৌধুরীর প্রতি দলীয় হাইকমান্ডের সুদৃষ্টি রয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি থাকছেন।

২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমকে সভাপতি ও সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এক সময়ে একরামুল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বর্তমান শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেল। ২০১৯ সালেওই সম্মেলনকে ঘেরে একরামুল করিম চৌধুরীর সাথে শহিদ উল্যাহ খান সোহেলের দুরত্ব সৃষ্টি হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে দলীয় প্রধানের দপ্তরে জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পুর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেওয়া হলে জেলা আওয়ামী লীগ কমিটি নিয়ে শুরু হয় বির্তক।

চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান দলীয় সাধারণ সম্পদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা। এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে কাদের মির্জা তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাকুরি বাণিজ্য ও লুটপাটের অভিযোগ এনে বক্তব্য দেন। এরপর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের স্থান না হওয়া নিয়েও বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে তিনি তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদের, ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী, আওয়ামী লীগের একাধিক মন্ত্রী ও এমপিদের নৈতিকতা নিয়েও বক্তব্য দেন। কাদের মির্জার এই বক্তব্যের পরপরই জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর কয়েকদিন পর নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টে লাইভে এসে ওবায়দুল কাদেরকে রাজাকার পরিবারের সদস্য হিসাবে আখ্যায়িত করে কয়েকদিনের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি দেওয়া না হলে তিনি এটা নিয়ে শুরু করবেন বলে মন্তব্য করেন।

কাদের মির্জা ও একারমুল করিম চৌধুরীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। কাদের মির্জার বিচার ও মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার চেয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির ও শ্রমিক আলা উদ্দিন। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এসব ঘটনায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। দলের নেতাকর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছেন। সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। তারা বলছেন, দুই নেতার দ্বন্দ্বের বলি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই দুই নেতার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও কর্মসূচি নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে। খুব শিগগির এর অবসান করা না হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ দলীয় কর্মকান্ডে ব্যাপক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিধাবিভক্ত নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সংকট নিরসনসহ চট্রগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার জন্য জাতীয় সংসদের হুইপ সাবেক ছাত্রনেতা আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপিকে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটতে পারে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। তবে চমক দিয়েই নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা হতে পারে। যারা ইতিমধ্যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে, বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অনেককে বাদ দেওয়া হবে। ক্লিন ইমেজের নতুন ব্যক্তি এই কমিটিতে স্থান পাবে।

জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় থাকা- মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল মালেক উকিলের ভাতুস্পুত্র এডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীনের কর্মী-সমর্থকরা জানান, ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে শিহাব উদ্দিন শাহীনই জেলা আওয়ামী লী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়ার যোগ্য দাবিদার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে চাচা আবদুল মালেক উকিলের অনুপ্রেরণায় ১৯৮০ থেকে ৮২ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে তার রাজনীতি শুরু। পরবর্তীতে নোয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর সদর (সদর ও কবিরহাট) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে অদ্যবধি দলের সকল আন্দোলন সংগ্রামে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। শিহাব উদ্দিন শাহীন ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী এক দলীয় নির্বাচনের চলমান অসহযোগ আন্দোলনে কারা বরণ করেন শাহীন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ একাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা বিতর্ক উঠলেও শিহাব উদ্দিন শাহীন ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে তার স্ব-অবস্থান ধরে রেখেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে শাহীনকে পদায়িত করলে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাবে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে নোয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেলের কর্মী-সমর্থকরা জানান, তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন নেতা শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেল। ১৯৮৭ সালে হরিনারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির পদ দিয়ে তার রাজনীতির পথ শুরু। পরবর্তীতে নোয়াখালী সরকারি কলেজের এজিএস, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সর্বশেষ নোয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১৬ সালের পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। দলীয় কর্মসূচিতে তার সরব অংশগ্রণ শহরবাসীর দৃষ্টি কাড়ে সব সময়। শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেলকে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দেওয়া হলে তার কাছে দল এবং কর্মী দুটোই নিরাপদ বলে দাবি করেন তার কর্মী-সমর্থকরা।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের চলমান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করিছি। নেত্রী আমার কথা শুনেছেন, দলীয় কর্মকান্ডের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। কমিটির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের নেগেটিভ-পজেটিভ সবই নেত্রী দেখবেন। এবিষয়ে নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App